সুষ্ঠ জ্ঞান, মানব স্বভাব ও মৌলিক শিক্ষার মানদণ্ডে হিন্দুধর্ম

⌘K
  1. Home
  2. Docs
  3. সুষ্ঠ জ্ঞান, মানব স্বভাব ...
  4. ৫। হিন্দুরা সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ককে কীভাবে দেখে?

৫। হিন্দুরা সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ককে কীভাবে দেখে?

বর্তমানে হিন্দুধর্মের অধিকাংশ মানুষ ওয়াহদাতুল উযূদ (সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার আত্মার একাত্মতার মতবাদ)-এ বিশ্বাস করে। ফলে সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টিবস্তুর সাথে একাকার। সুতরাং বর্তমান হিন্দুধর্মে ইলাহ তাঁর সৃষ্টবস্তুর বিস্তৃত। আর এতে অস্তিত্ব দানকারী অস্তিত্বে থাকা বস্তু একই জিনিস। [১৪] আর এ দর্শনটি বিজ্ঞান, যুক্তি, পর্যবেক্ষণ এবং বেদের সহজতম স্বতঃসিদ্ধের বিপরীত।
ওয়াহদাতুল উযূদ (সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার আত্মার একাত্মতার মতবাদ)-এর দর্শনে অসংখ্য জ্ঞানগত (বৈজ্ঞানিক) ও যুক্তিক সমস্যা-প্রশ্ন রয়েছে। যেমন:
প্রথম সমস্যা: তাদের মতে প্রভু সবকিছুর মধ্যেই বিদ্যমান, তাহলে প্রভুর সাথে একাত্মতা লাভের জন্য আচার-অনুষ্ঠান বা সাধনা করার অর্থ কী? যা “মোক্ষ”(Moksha, मोक्ष) নামে পরিচিত?
আপনি কিভাবে এমন কিছুতে পৌঁছাবেন যা আপনার মধ্যে রয়েছে…আপনি এতে বিদ্যমান এবং সে আপনার মধ্যে বিদ্যমান?
দ্বিতীয় সমস্যা: তাদের অস্তিত্বের একাত্মতার ধারণা মতে, ভুল-ত্রুটি এবং পাপও প্রভুর সত্তা; কেননা তাদের কাছে প্রভু নিজেই ভুল-ত্রুটি, এবং তিনি নিজেই পাপ, তিনি নিজেই ব্যভিচার, তিনি নিজেই হত্যা; যেহেতু তিনি প্রতিটি বস্তুর মাঝেই বিলীন; তাহলে ভুল-ত্রুটি এবং পাপ থেকে কেন নিষ্কৃতি পেতে হবে?
কেন তারা পার্থিব কামনা-বাসনা থেকে দূরে থাকতে এত আগ্রহী?
ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদের মধ্যেই কি পাপ নেই?
পৃথিবী কি নিজেই সত্তাগত প্রভু (এর অংশ) নয়?
বর্তমান হিন্দুদের এ ধারণা অনুসারে ভাল কাজ করার জন্য উদগ্রীব হওয়ার কোন যুক্তি নেই।
কিন্তু সবাই ভাল কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং এটিকে আবশ্যক কর্তব্য হিসেবে জানে, তাই না?
ভাল কাজ করার আগ্রহ হল পবিত্র প্রবৃত্তির আহ্বানে সাড়া দেওয়া। সুতরাং এটি অস্তিত্বের একাত্মতা দর্শনের ভ্রান্তির প্রত্যক্ষ একটি সহজাত প্রমাণ।
তৃতীয় সমস্যা: ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদ বিশ্বাস বাস্তবতার আপেক্ষিকতার দর্শনের দিকে আহ্বান করে; কারণ সমস্ত ধর্ম, যারা মূর্তি বা পাথরের পূজা করে, তাদের দৃষ্টিতে সেটি মূলত প্রভুর উপাসনা। কেননা তাদের উপলব্ধিতে তিনিই মূর্তি এবং তিনিই পাথর। তাই প্রভু সব কিছুর মধ্যেই আছেন এবং তিনিই সবকিছু।
বাস্তবতা প্রেক্ষিতে এ দর্শন সকল অর্থ ও মূল্যবোধকে ধ্বংসের দিকে আহ্বান করে, ফলে সবকিছুই সঠিক হয়ে যাবে।
উপরের বিষয়ের সাথে আরো একটি বিষয় যোগ করুন, তা হচ্ছে: ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদের বিশ্বাস একটি প্রশ্নের উত্তর দেয় না: পৃথিবী কোথা থেকে এসেছে?
তাই স্রষ্টার সত্তাকে সৃষ্ট বস্তু সত্তা ধরে নেয়া, এটি যুক্তির দিক দিক দিয়ে বাতিল। কারণ এতে ধরে নেওয়া হয় যে, কোন বস্তুর প্রকাশ পাওয়ার সম্পর্ক উক্ত বস্তুর প্রকাশ পাওয়ার উপর নির্ভরশীল।
এটি অত্যন্ত আজব একটি গড়মিল এবং বিবেকগত অসম্ভবও।
কিভাবে একটি জিনিস নিজের আত্মপ্রকাশের কারণ সেটি নিজেই। যখন সেটি এখনও অস্তিত্বে আসেনি?
চতুর্থ সমস্যা: এটি বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত যে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই নশ্বর এবং এটি সকল বিবেকবান মানুষের কাছেই সাব্যস্ত প্রমাণিত।
মহাবিশ্ব তার সমস্ত শক্তি, পদার্থ, স্থান এবং সময় সমেত একটি নশ্বর বস্তু…
অসংখ্য প্রমাণের মাধ্যমে এটি সাব্যস্ত যে, মহাবিশ্বের একটি শুরু ছিল। সুতরাং বৈজ্ঞানিকভাবে: কোন এক সময় মহাবিশ্ব ছিল না এবং তারপরে মহাবিশ্ব প্রকাশ পেল।
আর যখন মহাবিশ্ব ছিল না, তখন আমরা ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদ কিভাবে বলব?
যদি ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদ সত্য হয়, তবে এর জন্য আবশ্যক পৃথিবীর অবিনশ্বর হওয়া, অথবা অন্ততপক্ষে পদার্থের চিরন্তনতা।
আশ্চর্যজনকভাবে, সমসাময়িক হিন্দুরা জোর দিয়ে বলে যে, বস্তুজগৎ চিরন্তন। কারণ এটি এমন একটি প্রয়োজনীয় উক্তি যা ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদ প্রমাণে আবশ্যক।
হিন্দু পণ্ডিত বিবেকানন্দ (Wiwekanand) বলেছেন: “স্থান কোন সময় এবং নব অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত হয় না।”[১৫] বর্তমান হিন্দুরা এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছে যে, বস্তুজগত চিরন্তন, যাতে করে ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদের ধারণার সাথে তাদের কথা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
এতে তাদের প্রবেশ করাটা ঠিক ছিল না, আর প্রথমে তাদের অস্তিত্বের একত্ববাদে বিশ্বাস করাটাও সঠিক ছিল না। কিন্তু শয়তান আদম সন্তানের সব পথে বসে থাকে, মানুষদেরকে নবীদের দীন (ধর্ম) থেকে বিচ্যুত করে। যখনই সুযোগ পায় তা কাজে লাগায়।
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “নিশ্চয় আমি আমার বান্দাদেরকে (দীনের উপরে)একনিষ্ঠ করে সৃষ্টি করেছি, তারপর তাদের কাছে শয়তান এসে তাদেরকে তাদের দীন থেকে বিচ্যুত করেছে। তাদের উপর সে ঐ সমস্ত বস্তু হারাম করে দিল, যা আমি তাদের জন্য হালাল করেছিলাম। সে তাদেরকে নির্দেশ করল যেন তারা আমার সাথে শরীক স্থাপন করে, যার সপক্ষে আমি কোন প্রমাণ নাযিল করিনি।” [১৬] সুতরাং প্রতিটি মানুষই আল্লাহর একত্ববাদের উপরে ছিল, তারপরে তাদের কাছে শয়তান আগমন করল, আর তাদেরকে এসব কুফুরীর মাধ্যমে প্রতারিত করল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় শয়তান আদম সন্তানের পথগুলোতে বসে থাকে।” [১৭] সুতরাং শয়তান মানুষের ভ্রষ্টতার জন্য সব ধরণের উপায় খুঁজতে থাকে। আর নবীগণ যে একত্ববাদ ও ইবাদাতের উপরে ছিল, তা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোন পরিত্রানের পথ নেই।
বেদ স্পষ্টভাষায় বলছে যে, বিশ্বজগত সৃষ্ট, এবং এর একটি সূচনা রয়েছে।
আর আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা এবং তাদের মধ্যে বিদ্যমান নন।
তাহলে হিন্দুরা ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদের এ বিশ্বাসের পর্যায়ে কিভাবে পৌঁছালো?
ঋগবেদ (ऋग्वेद) বলে: “হে আল্লাহ (ভগবান)! সূর্য ও বিশ্ব তাদের উভয়েরই এ ক্ষমতা নেই যে, তারা আপনাকে আয়ত্ব করবে এবং আপনাকে ধারণ করবে।” [১৮] এটি বেদ থেকে একটি স্পষ্ট প্রমাণ যে, ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদের বিশ্বাস ভুল। আল্লাহ (প্রভু) তাঁর সৃষ্টি থেকে স্বাধীন সত্তা, এবং সূর্য ও চন্দ্রও ইলাহ বা প্রভু নয়।
ঋগবেদ আরো বলে: “আল্লাহ (প্রভু) তিনিই, রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন। এবং তিনিই জগতের এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তার মালিক। এবং তিনিই সূর্য ও চন্দ্র, যমীন ও আসমান সৃষ্টি করেছেন।” [১৯] সুতরাং অস্তিত্বের একাত্মতা ও বস্তুজগতের চিরন্তনতার বিশ্বাসকে নাকচ করার ক্ষেত্রে এর থেকে আর অন্য কোন স্পষ্ট দলীল থাকতে পারে কি?
যজুর্বেদ বলে: “তিনি হচ্ছেন এমন সত্তা, যার পূর্বে কোন বস্ত সৃষ্টি হয়নি। তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনি আমাদের মালিক আর তিনি সবকিছু জানেন।” [২০] সুতরাং মহাপ্রভুর (আল্লাহর) আগে অন্য কোন বস্তু সৃষ্টি হয়নি, তিনিই প্রথম, মহাবিশ্ব নশ্বর আর তা আল্লাহরই সৃষ্টি, তিনিই আসমান-যমীনের মহান মালিক।” [২১] আর কুরআন কারীমও এ একই মহাসত্যের কথা বলেছে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরে ১৪০০ বছর আগে অহী প্রেরণ করেছেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিজগত থেকে পৃথক, তিনি তাঁর আরশের উপরে উঠেছেন, কোন সৃষ্টবস্তু তাঁর সাথে একীভূত হতে পারে না, আর তিনিও কোন কিছুর সাথে একীভূত হন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَيۡنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍۚ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ ٤﴾ [السجدة: 4] ”আল্লাহ্, যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক নেই ও সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” সূরা আস-সাজদাহ: ৪।
সুতরাং নবীগণের বিশ্বাসের মূলকথা এবং তাদের দীন (ধর্ম) ও শরী‘আতের মূলকথা হচ্ছে: আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, একক, অদ্বিতীয়, পৃথক, তথা: তাঁর সৃষ্টিজগত থেকে আলাদা, এবং তাদের মধ্যে তিনি বিরাজিত নন।
ওয়াহদাতুুল ওয়াজূদ তথা সর্বেশ্বরবাদের বিশ্বাসের পঞ্চম সমস্যা হচ্ছে: এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না, তা হচ্ছে: বিশ্বজগত কোথা থেকে এসেছে?
এ দর্শন অনুযায়ী পৃথিবী কিভাবে উদ্ভব হয়েছিল?
তারপরে: এ দর্শনের প্রথম প্রবক্তা কে?
এর প্রমাণই বা কী?
আধুনিক বিজ্ঞান, যুক্তি, বেদ এবং নবীদের ধর্মের বিপরীত এই বিশ্বাসকে ঘিরে আরো অনেক প্রশ্ন এবং সমস্যা রয়েছে।

    How can we help?