ইসলামবিরোধীদের প্রতি জবাবকুরআনহাদিস

হিল্লা বিবাহের পোস্টমর্টেম

Contents Hide

আভিধানিক অর্থ

হিল্লা শব্দটি আরবি (حل) শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যার অর্থ সমাধান, ব্যবস্থা, উপায়, আশ্রয়, গতি ইত্যাদি।

সংজ্ঞা

প্রচলিত পরিভাষায় হিল্লা বিবাহ বলতে বোঝানো হয়: কোনো ব্যক্তির তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে এ শর্তে নতুন জায়গায় বিয়ে দেওয়া যে,বিয়ের পর সহবাস শেষে নতুন স্বামী এই স্ত্রীকে তালাক দেবে,যেন সে পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হয় এবং পুনরায় পূর্বের স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারে।
উক্ত বিবাহের মাধ্যমে তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা সংক্রান্ত পরিস্থিতির সমাধান দেয়া হয় বলে একে “হিল্লা বিবাহ” বলা হয়।

হিল্লা বিবাহের বৈধতা নিয়ে আলোচনা

ইসলামি শরিআতে হিল্লা বিবাহ হারাম। হাদিসে এসেছে,

لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُحِلَّ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ

যে হিল্লা করে এবং যার জন্য হিল্লা করা হয়,তাদের উভয়ের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অভিশাপ দিয়েছেন।[1]সুনানে ইবনে মাজাহ/হাঃ ১৯৩৪-১৯৩৬ (১/৬২৩ বৈরুত ছাপা), মুসনাদে আহমাদ ২/৩২৩, তিরমিজি ৪/২২১-২২২

قال عقبة بن عامر قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ألا أخبركم بالتيس المستعار؟ قالوا بلى يا رسول الله . قال : هو المحلل. لعن الله المحلل والمحلل له

‘উকবাহ ইবনু ‘আমির বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন: তোমাদেরকে কি সংবাদ দিবনা ভাড়া করা ষাঁড় (পাঁঠা )সম্পর্কে? তারা (উপস্থিত সাহাবীগণ) বললেন: জি হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল। রাসূল (সাঃ) বললেন: সে হচ্ছে হালালকারী। আল্লাহর অভিশাপ হালালকারীর উপর আর যার জন্য হালাল করা হয় তার উপর।[2]সুনানে আবু দাঊদ ২০৭৬, তিরমিজি ১১১৯, ইবনু মাজাহ ১৯৩৫, মুসনাদে আহমাদ ১/৮৩, ১২১ এ বর্ণিত। শায়খ আলবানী রহঃ তাঁর “সহীহ আবি দাঊদ” (১৮১১) এ সহিহ হিসাবে তাহকিক … See Full Note

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হিল্লাকারীকে ভাড়াটিয়া পাঁঠার সাথে তুলনা করেছেন, যেই পাঁঠা দিয়ে অন্য লোকের ছাগীকে প্রজনন করানো হয়। এ মর্মে হাদিসগুলো সহিহ, হাসান, যইফ ইত্যাদি সকল সূত্রেই বর্ণিত আছে। বহুসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হওয়ায় একটি অপরটির শাহেদ হয়ে হাদিসটি বলিষ্ঠ হয়েছে।

ইব্রাহিম নখঈ (রহঃ), হাসান বসরী (রহঃ), সায়িদ ইবনে মুসায়্যিব (রহঃ), মালিক বিন আনাস(রহঃ), সুফিয়ান সাওরী(রহঃ), লাইস ইবনু সাদ(রহঃ), আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ), মালিক ইবনু আনাস (রহঃ) প্রমুখ বলেছেন-

وقال سعيد بن المسيب إمام التابعين في رجل تزوج امرأة ليحلها لزوجها الأول فقال لا تحل وممن قال بذلك مالك بن أنس والليث بن سعد وسفيان الثوري والإمام أحمد

অর্থাৎ, “হিল্লার মাধ্যমে স্ত্রী পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হবে না।”[3]ইকামাতুত দালিল আলা ইবতালিত তাহলিল; ফতোয়া আল কুবরা – ইবনু তাইমিয়্যা ৬/৯, ৩/১০১-১০২; إغاثة اللهفان (১/২৭৪)।

হিল্লা বিবাহ জায়েজ তো নয়ই, উপরন্তু হিল্লা বিবাহ প্রতিরোধে ইসলামের চমৎকার বিধান

তীব্র ক্রোধের মাথায় কিংবা জোরপূর্বক পরিস্থিতিতে তালাক দিলে তালাক হবে না

অনেকসময়েই দেখা যায়, পুরুষ অতিরিক্ত রাগের মাথায় স্ত্রীকে তালাক দিয়ে পরবর্তীতে ভুল বুঝতে পারে। এরপর অসৎ সঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিশ্বাস করে নেয় যে, হিল্লা ছাড়া সেই স্ত্রী পুনরায় তার জন্য বৈধ হবে না! অথচ রাসুল(স) এর হাদিস অনুসন্ধানে আমরা দেখতে পাই,রাগের মাথায় তালাক দিলে সেই তালাক কার্যকর হবে না। খুব তীব্র রাগ যেখানে ব্যক্তি তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, নিজের অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না সে অবস্থায় তালাক কার্যকর হবে না।[4]মাজমূওল ফাতাওয়া ওয়ামাক্বলাত মুতানানাভিয়াহ – শাইখ ইবনে বায (রহঃ), ২১/৩৮৯

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ

গিলাক অবস্থায় কোনো তালাক হয় না এবং দাসত্বমুক্ত করা যায় না।[5]সুনানে ইবনে মাজাহ ২০৪৬, মুসনাদে আহমাদ ৬/২৭৬, সুনানে আবু দাউদ/হা-২১৯৩; শায়খ আলবানী রহঃ হাদিসটিকে হাসান বলেছেন, দেখুনঃ ইরওয়া ২০৪৬-২০৪৭

আলেমদের মতে এখানে গিলাক অর্থ জবরদস্তি এবং তীব্র ক্রোধ।[6]মারক্বাতুল মাফাতিহ ৫/২১৪০ তে মিশকাতুল মাসাবিহ হাদিস নং ৩২৮৫ এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য[7]كتاب إغاثة اللهفان في حكم طلاق الغضبان – ط عطاءات العلم পৃ ১৬-১৭

সুতরাং, যেই ব্যক্তি এরকম অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিয়ে পরবর্তীতে ভুল বুঝতে পেরেছে, তার উচিত সেই স্ত্রীকে হিল্লার মতো জঘন্য কাজে জড়িত না করে সরাসরি নিজ সংসারে ফিরিয়ে আনা।

তালাকের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই সালিশের মাধ্যমে এর মীমাংসা করার চেষ্টা করতে হবে

মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِن خِفتُم شِقاقَ بَينِهِما فَابعَثوا حَكَمًا مِن أَهلِهِ وَحَكَمًا مِن أَهلِها إِن يُريدا إِصلاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَينَهُما إِنَّ اللَّهَ كانَ عَليمًا خَبيرًا

অর্থ: আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।সূরা আন-নিসা,আয়াত ৩৫

বিবাহবিচ্ছেদের জন্য এক তালাকই যথেষ্ট

হিল্লা বিবাহের জন্য একটি বড় সহায়ক-শক্তি হচ্ছে একসাথে তিন তালাক বলাকে তিন তালাক হিসেবেই গণ্য করা। দক্ষিণ এশিয়ার ফকিহগণ এই মত প্রকাশ করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ অঞ্চলের সমাজে এ ধারণা প্রচলিত আছে যে, একসাথে “তালাক তালাক তালাক” বললেই তিন তালাক হয়ে যায় এবং এরপর কখনো স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে চাইলে হিল্লা বিবাহ করিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে!

আমাদের নিকট অধিক সঠিক মত হচ্ছে: এক বৈঠকে তিনবার কেনো, তিন লক্ষবার তালাক দিলেও সেটা এক তালাক বলেই গণ্য হবে।
এক তালাক এবং দুই তালাক পর্যন্ত স্ত্রীকে সরাসরি ফিরিয়ে নেয়া যায়। হিল্লা দিতে হয় না। নিম্নে এ মর্মে কিছু দলিল পেশ করা হলোঃ

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

আব্দু ইয়াযীদ তার স্ত্রী উম্মে রূকানাকে তালাক দেন। পরবর্তীতে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত হন। তখন রাসূল (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে কিভাবে তালাক দিয়েছ? তিনি উত্তরে বলেন, এক বৈঠকে তিন তালাক দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,তাহলে এক তালাকই হয়েছে। তুমি স্ত্রীকে ফেরত নাও’[8]মুসনাদে আহমাদ/হা-২৩৮৭; আউনুল মাবুদ ৬/১৩৮, সুনানে আবু দাঊদ ২১৯৬; শাইখ বিন বায (রহঃ) তাঁর বুলুগুল মারামের হাশিয়া ৬১৫ গ্রছে, উক্ত হাদিস দ্বারা দলিল প্রদান … See Full Note

ইবন তাউস (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আবু সাহবা (রহঃ) ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট এসে বললেন : হে ইব্‌ন আব্বাস! আপনি কি জানেন না, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে এবং আবু বকর ও উমর (রাঃ)-এর প্রথম যুগে তিন তালাককে এক তালাক ধরা হতো ? তিনি বললেন : হ্যাঁ।[9]সহীহ মুসলিম ৩৫৬৫-৩৫৬৭ হাদীস একাডেমী, সুনানে আন-নাসায়ী ৩৪০৬, সুনানে আবু দাউদ ২২০০

মাহমুদ ইবনে লাবীদ(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুলাহ (ﷺ)- কে এক ব্যক্তি সম্বন্ধে অবহিত করা হলো, সে তার স্ত্রীকে একত্রে তিন তালাক দিয়েছে। এ কথা শুনে তিনি রাগান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেনঃ সে কি আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা করছে? অথচ আমি তোমাদের মাঝেই রয়েছি। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললঃ ইয়া রাসুলুল্লাহ্। আমি কি তাকে হত্যা করবো না?[10]সুনানে আন-নাসায়ী/হা-৩৪০১; বুলুগুল মারাম/হা-১০৭২

সুতরাং,একসাথে তিন তালাক প্রদান করা জায়েজ নেই।সালিশের মাধ্যমেও স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ মীমাংসা করা সম্ভব না হলে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে।তখন এক তালাক দেয়াই যথেষ্ট হবে।

এক তালাকের নিয়ম

তালাক মূলত দিতে হবে নির্দিষ্ট হায়েজ থেকে পবিত্র হওয়ার পর সহবাসহীন অবস্থায়।[11]সহিহে মুসলিম/হা-৩৫৪৬

তালাকের পর স্ত্রী তিন মাসিক পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَالمُطَلَّقاتُ يَتَرَبَّصنَ بِأَنفُسِهِنَّ ثَلاثَةَ قُروءٍ

অর্থ: আর তালাকপ্রাপ্তা নারীরা তিন কুরূ বা তিন ইদ্দত পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকবে…
সূরা আল-বাকারা,আয়াত ২২৮

الطَّلاقُ مَرَّتانِ فَإِمساكٌ بِمَعروفٍ أَو تَسريحٌ بِإِحسانٍ……

অর্থ: তালাক দু’বার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে (৩য় তালাক দেবে)……
সূরা আল-বাকারা,আয়াত ২২৯

সুতরাং, তালাক ধাপে ধাপে দিতে হয়। তিন তালাক একত্রে না। এই আয়াত থেকে দেখা যায়,তিন তালাকের আগ পর্যন্ত সরাসরি স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। শরিয়তের পরিভাষায় এরূপ তালাককে “তালাকে রাজঈ” বলা হয়। তিন তালাকের আগ পর্যন্ত হিল্লার প্রসঙ্গই উঠবে না।

সবচেয়ে কম সময়ে তিন তালাক বা চূড়ান্ত তালাক দিতে চাইলে স্ত্রীর তিন হায়েজের মধ্যে কখনোই তালাক প্রত্যাহার করে তাকে রাজ’আত বা ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। বরং প্রতি হায়েজ শেষে একটি করে তালাক দিয়ে তিন তালাক পূর্ণ করতে হবে।[12]সুনানে আন-নাসায়ী/হা-৩৩৯৪ https://ihadis.com/nasai/hadith/3394। অর্থাৎ, তিন তালাক দিতে হয় সর্বনিম্ন তিন রজঃস্রাব সময় নিয়ে। এটিই সুন্নাহ নিয়ম।

আর যদি এক তালাক দিয়েই বিদায় করে দিতে চায় অর্থাৎ, প্রথমবার তালাক দিয়ে পরবর্তী হায়েজগুলোতে তালাক না দেয়, তাহলে তা এক তালাক হিসেবেই থেকে যাবে। এক তালাকই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট[13]সুনানে আন-নাসায়ী/হা-৩৪৬৩; সহীহে বুখারী/হা-৫২৭৩। শরিয়তের পরিভাষায় এটিকে “বায়েন-এক-তালাক” ও বলা হয়।
ইবনে আবি-শাইবা তার গ্রন্থে ইবরাহীম নাখা্‌’য়ী রাহিমাহুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, সাহাবীগণ তালাকের ব্যাপারে এ পদ্ধতিকেই পছন্দ করেছেন যে, মাত্র এক তালাক দিয়েই ছেড়ে দিবে এবং এতেই ইদ্দত শেষ হলে বিবাহ বন্ধন স্বাভাবিকভাবেই ছিন্ন হয়ে যাবে।
সাহাবীগণ একে তালাকের সর্বোত্তম পন্থা বলে অভিহিত করেছেন।[14]তাফসীরে জাকারিয়া, কুরআন ২ঃ২৩০ এর তাফসির দ্রষ্টব্য; ইবনে আবী শাইবাহ ১৭/৭৪৩

এক তালাকের পর ইদ্দত অতিক্রান্ত হয়ে গেলে সেই নারীকে আর রাজ’আত করা যাবে না।নতুনভাবে বিবাহ করে ঘরে তুলতে হবে [সুনানে ইবনে মাজাহ/হা-২০২৬]।

এক তালাকের পর নারী চাইলে অবিবাহিতও থাকতে পারে কিংবা নতুন কাউকে বিবাহও করতে পারে কিংবা পূর্বের স্বামীর সাথে মনোমালিন্য মিটে গেলে পুনরায় তারা সরাসরি বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হতে পারে।যেহেতু তাদের কেবল এক তালাক হয়েছিলো,তাই এখানে হিল্লার কোনো প্রসঙ্গই উঠবে না।

একই নিয়মে দুই তালাক পর্যন্তও সরাসরি পূর্বের স্বামীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।হিল্লার প্রসঙ্গই উঠবে না।

দুই রাজঈ তালাক কিংবা দুই বায়েন তালাকের পর স্বামীর হাতে থাকা অবশিষ্ট তালাকও দিয়ে দেয়া হ’লে তাকে মুগাল্লাযা তালাক বলে। মুগাল্লাযা অর্থ চূড়ান্ত। এই তালাকের পর ইদ্দতের মধ্যে কিংবা শেষে স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে নেয়া যাবে না।

ইদ্দত চলাকালে স্ত্রী স্বামীর গৃহে থাকবে

এক বা দুই তালাকের পর ইদ্দত চলাকালে স্ত্রী স্বামীর গৃহে থাকবে এবং খোরপোষ পাবে।
তবে তিন তালাকের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সেই গৃহ থেকে চলে যেতে হবে এবং খোরপোষ পাবে না।[15]সূরা ত্বলাক, আয়াত ১-২; সুনানে আন-নাসায়ী/হা-৩৪০৩

এখানেও মহান আল্লাহ তা’আলার করুণা প্রদর্শিত হয়। তিনি এই যুগলকে তালাকের পরও মোটামুটি ৩ মাস একসাথে থাকার সুযোগ দিয়েছেন যাতে তাদের মন পরিবর্তন হতে পারে এবং ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে। ফলে তারা রাজ’আতের মাধ্যমে পুনরায় বৈবাহিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে।

হিল্লার আইডিয়া যেখান থেকে এলো (আদৌ কি সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৩০ এ হিল্লা বিবাহ আছে?)

সূরা আল বাকারাহ, আয়াত-২৩০ঃ

فَإِن طَلَّقَها فَلا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعدُ حَتّى تَنكِحَ زَوجًا غَيرَهُ فَإِن طَلَّقَها فَلا جُناحَ عَلَيهِما أَن يَتَراجَعا إِن ظَنّا أَن يُقيما حُدودَ اللَّهِ وَتِلكَ حُدودُ اللَّهِ يُبَيِّنُها لِقَومٍ يَعلَمونَ

আহসানুল বয়ান অনুবাদঃ
অতঃপর উক্ত স্ত্রীকে যদি সে (তৃতীয়) তালাক দেয়, তবে যে পর্যন্ত না ঐ স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করবে, তার পক্ষে সে বৈধ হবে না। অতঃপর ঐ দ্বিতীয় স্বামী যদি তাকে তালাক দেয় এবং যদি উভয়ে মনে করে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে, তাহলে তাদের (পুনর্বিবাহের মাধ্যমে দাম্পত্য-জীবনে) ফিরে আসায় কোন দোষ নেই। এ সব আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা, জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ এগুলি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন।

Sahih International:
And if he has divorced her [for the third time], then she is not lawful to him afterward until [after] she marries a husband other than him. And if the latter husband divorces her [or dies], there is no blame upon the woman and her former husband for returning to each other if they think that they can keep [within] the limits of Allah . These are the limits of Allah, which He makes clear to a people who know.

মহান আল্লাহ সূরা বাকারার ২২৯ নাম্বার আয়াতে ধাপে ধাপে তিন তালাকের বর্ণনা দেয়ার পর ২৩০ নাম্বার আয়াতে এসে তালাক-পরবর্তী অবস্থার কথা বলেছেন। সুতরাং এটি হচ্ছে তৃতীয় তালাকের পরবর্তী অবস্থা। তাফসীরে ইবনে কাসীরেও এই আয়াতের জন্য তিন তালাকের ব্যাখা করা হয়েছে।[16]তাফসীরে ইবনে কাসীর:২/২৩০

কুরআন-হাদিসের জ্ঞান নেই এমন কিছু অজ্ঞ ব্যক্তি তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে উক্ত আয়াত ব্যবহার করে হিল্লা বিবাহের মাধ্যমে এরূপ পরিস্থিতির সমাধান দেয়। এখন আমাদের দেখতে হবে,আয়াতটি কি আদৌ হিল্লা বিবাহকে সমর্থন করে?

আয়াতটির ব্যাখা ৩ ধরনের হতে পারে।

  1. স্রেফ রায়ভিত্তিক ব্যাখা
  2. শানে নুযুল ও হাদিসভিত্তিক ব্যাখা
  3. ব্যাকরণগত ও হাদিসভিত্তিক ব্যাখা

স্রেফ রায়ভিত্তিক ব্যাখা

আহলুর রায়গণ এই আয়াতটিকে একটি শর্ত হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তিন তালাকপ্রাপ্তা নারীকে পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ ও কৃত্রিম উভয় পদ্ধতিকেই সমর্থন করে থাকেন। আগ্রহের পদ্ধতি হচ্ছে – নারীটি তিন তালাকের পর স্বেচ্ছায় আগ্রহের ভিত্তিতে অপর স্বামী গ্রহণ করেছে এবং তার সাথে স্বাভাবিকভাবেই সহবাস হয়েছে,অতঃপর স্বাভাবিকভাবেই নতুন স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে/মৃত্যুবরণ করেছে। তখন এই আয়াতের শর্ত মোতাবেক,নারীটি তার পূর্বের স্বামীর সাথে পুনরায় বিয়ের জন্য হালাল হয়ে গেছে। সুতরাং,কখনো যদি পূর্বের স্বামীর কাছে পুনরায় ফিরে আসতে চায়,তাহলে নির্দ্বিধায় ফিরে আসতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে তাদের পুনরায় বিবাহ হওয়া জরুরি।
আর কৃত্রিম পদ্ধতি হচ্ছে – হিল্লা বিবাহ। অর্থাৎ, তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে প্রথম স্বামীর জন্য হালাল করতে সাময়িক বা অস্থায়ীভাবে অপর একজন পুরুষের কাছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিবাহ দেওয়া, সহবাস হওয়া ও স্বল্প সময়েই তালাক করানো। এরপর নারীটি প্রথম স্বামীর সাথে পুনরায় বিবাহের জন্য হালাল হবে।

রায়ভিত্তিক ব্যাখার সমস্যা: আহলুর রায়গণের ব্যাখা অনুযায়ী যদি এই আয়াত থেকে কৃত্রিম পদ্ধতি (হিল্লা বিবাহ) এর স্বপক্ষে দলীল গ্রহণ করা হয়, তাহলে কুরআন ও সহীহ হাদিসের সাথে তা সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। কেননা কুরআন যেখানে বিবাহ টিকিয়ে রাখতে স্ত্রীকে সদুপদেশ দেয়া, বিছানা ত্যাগ, প্রতীকী প্রহার, এমনকি সালিশের আদেশ পর্যন্ত দিয়েছে[17]সূরা নিসা,আয়াত ৩৪-৩৫, সেখানে হিল্লাকারী ব্যক্তি কুরআনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিবাহটাই করছে তালাক দেয়ার উদ্দেশ্যে! এছাড়া হাদিসে তো হিল্লা বিবাহের ভুরি ভুরি নিষেধাজ্ঞা রয়েছেই।
পাশাপাশি আহলে রায়গণের দাবি অনুযায়ী যদি একই সাথে তিন তালাক প্রদান কার্যকর ধরা হয় এবং স্ত্রীটি অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ ছাড়া পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল না হয়, তবে স্ত্রীকে তিন ইদ্দতে তিন তালাক ও শরিআতে স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার (রাজ’আত করার) যে সুযোগ রাখা হয়েছে তা খর্ব করা হয়। এছাড়া দুই তালাক পর্যন্ত স্ত্রীর জন্য যে বাসস্থান ও খোরপোষের বিধান রাখা হয়েছে, সেটিও পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়। উপরন্তু এর দ্বারা কুরআন এবং সহিহ হাদিসেরও সরাসরি বিরোধিতা করা হয়।
একারণেই ইমাম ওয়াকী (রহঃ) বলেছেন, হিল্লা বিবাহ বিষয়ে আহলুর রায়ের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়া কর্তব্য।[18]সুনানে তিরমিজি/হা-১১২০

শানে নুযুল ও হাদিসভিত্তিক ব্যাখা

তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে আলোচ্য আয়াতের শানে নুযুল :

“ইসলামের পূর্বে প্রথা ছিল এই যে, স্বামী যত ইচ্ছা স্ত্রীকে তালাক দিতো এবং ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিতো। ফলে স্ত্রীগণ সংকটপূর্ণ অবস্থায় পতিত হয়েছিল। স্বামী তাদেরকে তালাক দিতো এবং ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার নিকটবর্তী হতেই ফিরিয়ে নিতো। পুনরায় তালাক দিতো। কাজেই স্ত্রীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ইসলাম এই সীমা নির্ধারণ করে দেয় যে, এভাবে মাত্র দু’টি তালাক দিতে পারবে। তৃতীয় তালাকের পর ফিরিয়ে নেয়ার আর কোন অধিকার থাকবে না।…..

মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতীম’ গ্রন্থে রয়েছে যে, এক ব্যক্তি স্বীয় স্ত্রীকে বলে-“আমি তোমাকে রাখবোও না এবং ছেড়েও দেবো না। স্ত্রী বলে : ‘কিরূপে?’ সে বলে : তোমাকে তালাক দেবো এবং ইদ্দত শেষ হওয়ার সময় হলেই ফিরিয়ে নেবো। আবার তালাক দেবো এবং ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বেই পুনরায় ফিরিয়ে নেবো। এরূপ করতেই থাকবো। ঐ স্ত্রীলোকটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তার এই দুঃখের কথা বর্ণনা করে। তখন এই পবিত্র আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর ঐলোকগুলো তালাকের প্রতি লক্ষ্য রাখতে আরম্ভ করে এবং শুধরে যায়।[19]তাফসীরে ইবনে কাসীর, কুরআন ২/২৩০

সুতরাং, এই আয়াত নাজিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে খারাপ স্বামীদের হাত থেকে নারীদের বাঁচানো। অথচ ইসলামবিদ্বেষীরা এই আয়াতকেই নারীর অবমাননা বলে চালিয়ে দেয়!

আহলুর রায়ের কৃত্রিম হিল্লার ব্যাখাটি কুরআন ও হাদিসের আলোকে বাতিল সাব্যস্ত হওয়ায় কেবল একটি অপশনই অবশিষ্ট থেকে যাচ্ছে।সেটি হচ্ছে স্বাভাবিক আগ্রহের বিয়ের মাধ্যমে এই আয়াতের হুকুম কার্যকর হওয়া।এছাড়া হাদিসেও আগ্রহের বিবাহের কথা বর্ণিত হয়েছে,
রাসুল(ﷺ)কে হিল্লাকারী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:

” لا إلا نكاح رغبة ، لا نكاح دلسة ولا “استهزاء بكتاب الله

“আগ্রহ ছাড়া কোনো বিবাহ নেই, প্রতারণার জন্য কোনো বিবাহ নেই এবং আল্লাহর কিতাবকে উপহাস করার জন্যও কোনো বিবাহ নেই”[20]তাফসীরে ইবনে কাসীর, কুরআন ২/২৩০; হাদিসটি শাহেদ এর ভিত্তিতে বলিষ্ঠ

ইবনে ওমর(রাঃ) এর ফতোয়াঃ

ইমাম হাকেম নাফে থেকে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি ইব্‌ন ওমর (রাঃ)কে বলে:

امرأة تزوجتها أحلها لزوجها ، لم يأمرني ولم يعلم . قال : لا ، إلا نكاح رغبة ، إن أعجبتك أمسكها ، وإن كرهتها فارقها . قال : وإن كنا نعده على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم سفاحاً . وقال : لا يزالان زانيين ، وإن مكثا عشرين سنة .

আমি এক নারীকে তার স্বামীর জন্য হালাল করার নিয়তে বিয়ে করেছি, আমাকে সে নির্দেশ দেয়নি এবং আমার নিয়ত সম্পর্কে সে জানেও না। তিনি বললেন : না, আগ্রহের বিয়ে ব্যতীত হালাল হবে না, যদি তোমার পছন্দ হয় তাকে রেখে দেবে, আর যদি তোমার অপছন্দ হয় তাকে পৃথক করে দেবে। তিনি বললেন : আমরা এটাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যেনা বিবেচনা করতাম। তিনি বলেন : তারা যেনা করতেই থাকবে, যদিও তারা এ অবস্থায় বিশ বছর অতিক্রান্ত করে।[21]ত্বাবারাণী, বায়হাক্বী, হাকেম, ইরওয়া হা/১৮৯৮, ৬/৩১১, “তালাক ও তাহলীল” বই দ্রষ্টব্য

উসমান (রাঃ) এর ফতোয়াঃ
ইব্‌ন ওহাব আব্দুর রহমান মুরাদি থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আবু মারওয়ান তাজিবিকে বলতে শুনেছেন :

إن رجلا طلق امرأته ثلاثا ندما وكان له جار فأراد أن يحلل بينهما بغير علمهما فسأل عن ذلك عثمان فقال له عثمان إلا نكاح رغبة غير مدالسة.

“এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে লজ্জিত হয়, তার এক প্রতিবেশী ছিল, যে তাদের অজান্তে উভয়ের মাঝে হিল্লা করার ইচ্ছা করে, এ সম্পর্কে তিনি উসমান(রাঃ)কে জিজ্ঞাসা করেন, উসমান(রাঃ) তাকে বলেন, প্রতারণাহীন আগ্রহের বিয়ে ব্যতীত হালাল হবে না”।[22]আল মুহাল্লা বিল আছার ৯/৪২৮; ফাতাওয়ায়ে আল কুবরা ইবনে তাইমিয়্যা ৬/২৪৩

হিল্লাকারীর সাথে তিন তালাকপ্রাপ্তা নারীর বিবাহ আগ্রহের ভিত্তিতে সংঘটিত হয় না,বরং এখানে স্রেফ পূর্ব-স্বামীর জন্য হালাল করার নিয়ত থাকে।তাই হিল্লা বিবাহ বাতিল।

যারা বারবার তালাক দিতো ও বারবার ফিরিয়ে নিতো,তারা এখন থেকে আর এই ধরনের কাজ করতে পারবে না।কেননা তিন তালাকের পর লোকটি আর ওই স্ত্রীকে সহজে ফিরিয়ে নিতে পারবে না।যতক্ষণ না নারীটি আগ্রহের ভিত্তিতে অপর স্বামী গ্রহণ করবে এবং তার সাথে স্বাভাবিকভাবেই সহবাস হবে, অতঃপর স্বাভাবিকভাবেই নতুন স্বামী তাকে তালাক দিবে (হিল্লার উদ্দেশ্যে নয়) /মৃত্যুবরণ করবে। এরপর নারীটি তার পূর্বের স্বামীর সাথে পুনরায় বিয়ের জন্য হালাল হবে। পরবর্তীতে কখনো যদি নারীটি পূর্বের স্বামীর কাছে পুনরায় ফিরে আসতে চায় এবং পূর্বের স্বামীও রাজি থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় পুনর্বিবাহের মাধ্যমে ফিরে আসতে পারবে।

ব্যাকরণগত ও হাদিসভিত্তিক ব্যাখা

অনেক মুফাসসির কুরআন ২/২৩০ এ ব্যবহৃত আরবি “تَنكِح” শব্দটির ক্ষেত্রে বিবাহের বদলে “সহবাস করা/সংগত হওয়া” এ জাতীয় অর্থ গ্রহণ করেছেন। আরবি ডিকশনারি মতেও অর্থটি সিদ্ধ।

আবু বকর জাকারিয়া (হাফি.) এর অনুবাদ:

সূরা আল বাকারাহ,আয়াত-২৩০

فَإِن طَلَّقَها فَلا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعدُ حَتّى تَنكِحَ زَوجًا غَيرَهُ فَإِن طَلَّقَها فَلا جُناحَ عَلَيهِما أَن يَتَراجَعا إِن ظَنّا أَن يُقيما حُدودَ اللَّهِ وَتِلكَ حُدودُ اللَّهِ يُبَيِّنُها لِقَومٍ يَعلَمونَ

অনুবাদঃ
অতঃপর যদি সে স্ত্রীকে তালাক দেয় তবে সে স্ত্রী তার জন্য হালাল হবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সাথে সংগত না হবে। অতঃপর সে (দ্বিতীয় স্বামী) যদি তালাক দেয় আর তারা উভয়ে (স্ত্রী ও প্রথম স্বামী) মনে করে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করতে পারবে তবে তাদের পুনর্মিলনে কারো কোন অপরাধ হবে না। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা, যা তিনি স্পষ্টভাবে এমন কওমের জন্য বর্ণনা করেন, যারা জানে।

ব্যাকরণগত ও হাদিসভিত্তিক ব্যাখায় কুরআন ২/২৩০ এ ব্যবহৃত আরবি تَنكِح শব্দটিকে “সহবাস করা/সংগত হওয়া” অনুবাদ করা হয় এবং আয়াতটিকে অন্য ব্যক্তির সাথে বিয়ে করার শর্ত হিসেবে গ্রহণ না করে একটি “সম্ভাবনা বা পরিস্থিতি” হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ, নারীটির তিন তালাকের পর অন্য ব্যক্তির কাছে বিয়ে হয়ে গেছে এবং অন্য ব্যক্তির কাছে বিবাহধীন থাকা অবস্থায় হঠাৎ কোনো কারণে তার ইচ্ছা জাগলো পূর্বের স্বামীর কাছে ফিরে আসার। সূরা বাকারার ২৩০ আয়াতের হুকুম নতুন স্বামীর কাছে বিবাহধীন থাকাবস্থায় প্রযোজ্য এবং “تَنكِح” শব্দটি সহবাস অর্থে ব্যবহৃত তার দলিলগুলো হলোঃ

  • সহীহে বুখারী/হা-২৬৩৯, ৫২৬০
  • সহীহে মুসলিম/হা-৩৪১৮ ইত্যাদি।

কিন্তু কুরআন তার সরাসরি ফিরে আসাকে সমর্থন করে না।  কেননা ইসলামি শরিআহ মতে তালাকের বিষয়টি নারীর হাতে নেই। সে যখন ইচ্ছা তখন বিবাহ ভেঙে দিয়ে যার তার কাছে চলে যাওয়ার অধিকার রাখে না।[23]অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। কাবিননামার ১৮ নং ধারায় শরিআহ আইন মোতাবেক বিবাহের সময়ই স্ত্রী চাইলে স্বামীর কাছ থেকে তালাকের এখতিয়ার নিয়ে রাখতে পারেন [সুনানে … See Full Note যাকে বিবাহ করবে,তার যাবতীয় প্রাপ্য হক নারীটির আদায় করতে হবে।পাশাপাশি কুরআন সেই নারীটিকে বর্তমান স্বামীর দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছে এবং বর্তমান স্বামীর সাথে ভালোবাসা মজবুতকরণে সহবাসকে শর্ত করেছে। ফলে দেখা যাবে, নারীটির পূর্বের স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা দূর হয়ে গেছে। যে স্বামী তাকে পাষন্ডের মতো বারবার তালাক দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে, তার কাছে যাতে সহজেই নারীটি পুনরায় ফিরে গিয়ে অত্যাচারিত হতে না পারে সেজন্যই আল্লাহর এই ব্যবস্থা।
বর্তমান স্বামীর সাথে সহবাসের পর যদি স্বাভাবিক নিয়মে তার তালাক হয় (হিল্লার নিয়তে না) অথবা বর্তমান স্বামী মৃত্যুবরণ করে,তাহলে নারীটি চাইলে পূর্বের স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারবে।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ২ নং ও ৩ নং পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই কেবল সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াত প্রযোজ্য হবে। হিল্লা বিবাহের ক্ষেত্রে না।

ইসলামি শরীয়তে হিল্লা বিবাহের শাস্তি

ইবনে উমর রাঃ থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে,

وإنا كنا نعد هذا سفاحا على عهد رسول الله.

ইবন ওমর (রাঃ) হিল্লা বিবাহ প্রসঙ্গে বলেন, “…আমরা এটাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর যুগে ব্যাভিচার বলে গণ্য করতাম…”।[24]ইগাসাতুল লাহফান লি ইব্নুল ১/৪১১

কুবাইসা ইবন জাবের বর্ণনা করেন, হযরত উমর(রাঃ) বলেছেন:-

والله لا أوتى بمحلٍّ ومحلَّل له إلا رجمتهما .

“হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করা হয়, তাদেরকে আমার সামনে পেশ করা হলে আমি উভয়কে রজম (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) করব”।[25]ইকামাতুত দালিল আলা ইবতালিত তাহলিল, ইবনুল মুনযির, মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবাহ, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/১৩৪ : “তালাক ও তাহলীল” বই … See Full Note

আব্দুল মালিক ইব্‌ন মুগিরা ইব্‌ন নাওফেল থেকে বর্ণিত,

أن ابن عمر سئل عن تحليل المرأة لزوجها قال: ذلك السفاح لو أدرككم عمر لنكلكم.

“ইবনে ওমরকে (রা.) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, স্ত্রীকে তার স্বামীর জন্য হালাল করার বিধান কি, তিনি বলেন : এটা যেনা, যদি ওমর তোমাদের দেখত, তাহলে অবশ্যই তিনি তোমাদের শাস্তি দিতেন”।[26]মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৯/৪৪৯, হাঃ ১৭৯৬১, সহিহ

মহান আল্লাহ আমাদেরকে হিল্লা বিবাহ নামক এই অজ্ঞতা ও কুরআন-হাদিসবিরোধী জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন।

আমীন।

    Footnotes

    Footnotes
    1সুনানে ইবনে মাজাহ/হাঃ ১৯৩৪-১৯৩৬ (১/৬২৩ বৈরুত ছাপা), মুসনাদে আহমাদ ২/৩২৩, তিরমিজি ৪/২২১-২২২
    2সুনানে আবু দাঊদ ২০৭৬, তিরমিজি ১১১৯, ইবনু মাজাহ ১৯৩৫, মুসনাদে আহমাদ ১/৮৩, ১২১ এ বর্ণিত। শায়খ আলবানী রহঃ তাঁর “সহীহ আবি দাঊদ” (১৮১১) এ সহিহ হিসাবে তাহকিক করেছেন
    3ইকামাতুত দালিল আলা ইবতালিত তাহলিল; ফতোয়া আল কুবরা – ইবনু তাইমিয়্যা ৬/৯, ৩/১০১-১০২; إغاثة اللهفان (১/২৭৪)।
    4মাজমূওল ফাতাওয়া ওয়ামাক্বলাত মুতানানাভিয়াহ – শাইখ ইবনে বায (রহঃ), ২১/৩৮৯
    5সুনানে ইবনে মাজাহ ২০৪৬, মুসনাদে আহমাদ ৬/২৭৬, সুনানে আবু দাউদ/হা-২১৯৩; শায়খ আলবানী রহঃ হাদিসটিকে হাসান বলেছেন, দেখুনঃ ইরওয়া ২০৪৬-২০৪৭
    6মারক্বাতুল মাফাতিহ ৫/২১৪০ তে মিশকাতুল মাসাবিহ হাদিস নং ৩২৮৫ এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য
    7كتاب إغاثة اللهفان في حكم طلاق الغضبان – ط عطاءات العلم পৃ ১৬-১৭
    8মুসনাদে আহমাদ/হা-২৩৮৭; আউনুল মাবুদ ৬/১৩৮, সুনানে আবু দাঊদ ২১৯৬; শাইখ বিন বায (রহঃ) তাঁর বুলুগুল মারামের হাশিয়া ৬১৫ গ্রছে, উক্ত হাদিস দ্বারা দলিল প্রদান করা যাবে।
    9সহীহ মুসলিম ৩৫৬৫-৩৫৬৭ হাদীস একাডেমী, সুনানে আন-নাসায়ী ৩৪০৬, সুনানে আবু দাউদ ২২০০
    10সুনানে আন-নাসায়ী/হা-৩৪০১; বুলুগুল মারাম/হা-১০৭২
    11সহিহে মুসলিম/হা-৩৫৪৬
    12সুনানে আন-নাসায়ী/হা-৩৩৯৪ https://ihadis.com/nasai/hadith/3394
    13সুনানে আন-নাসায়ী/হা-৩৪৬৩; সহীহে বুখারী/হা-৫২৭৩
    14তাফসীরে জাকারিয়া, কুরআন ২ঃ২৩০ এর তাফসির দ্রষ্টব্য; ইবনে আবী শাইবাহ ১৭/৭৪৩
    15সূরা ত্বলাক, আয়াত ১-২; সুনানে আন-নাসায়ী/হা-৩৪০৩
    16তাফসীরে ইবনে কাসীর:২/২৩০
    17সূরা নিসা,আয়াত ৩৪-৩৫
    18সুনানে তিরমিজি/হা-১১২০
    19তাফসীরে ইবনে কাসীর, কুরআন ২/২৩০
    20তাফসীরে ইবনে কাসীর, কুরআন ২/২৩০; হাদিসটি শাহেদ এর ভিত্তিতে বলিষ্ঠ
    21ত্বাবারাণী, বায়হাক্বী, হাকেম, ইরওয়া হা/১৮৯৮, ৬/৩১১, “তালাক ও তাহলীল” বই দ্রষ্টব্য
    22আল মুহাল্লা বিল আছার ৯/৪২৮; ফাতাওয়ায়ে আল কুবরা ইবনে তাইমিয়্যা ৬/২৪৩
    23অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। কাবিননামার ১৮ নং ধারায় শরিআহ আইন মোতাবেক বিবাহের সময়ই স্ত্রী চাইলে স্বামীর কাছ থেকে তালাকের এখতিয়ার নিয়ে রাখতে পারেন [সুনানে ইবনে মাজাহ/হা-২০৫২]। এরপর স্ত্রী বিচারকের মাধ্যমে সেই স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে পারেন।তবে একান্ত অসুবিধা ব্যাতীত স্বামীর কাছ থেকে তালাকের দাবি করা হারাম [সুনানে ইবনে মাজাহ/হা-২০৫৫]
    24ইগাসাতুল লাহফান লি ইব্নুল ১/৪১১
    25ইকামাতুত দালিল আলা ইবতালিত তাহলিল, ইবনুল মুনযির, মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবাহ, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/১৩৪ : “তালাক ও তাহলীল” বই দ্রষ্টব্য
    26মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৯/৪৪৯, হাঃ ১৭৯৬১, সহিহ
    Show More
    0 0 votes
    Article Rating
    Subscribe
    Notify of
    guest
    0 Comments
    Inline Feedbacks
    View all comments
    Back to top button