ইতিহাস

গরুর গোশত আমরা এ অঞ্চলের মুসলিমরা কেন খাই? এর ইতিহাস কী?

[১]

১১৭৮ সালে আরব থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য বাংলায় আসেন সুফি বাবা আদম শহীদ (রহ.)। তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে এক কোরবানির সময় গরু জবাই করেন। এই কথা পৌঁছে যায় রাজা বল্লাল সেনের কাছে। সে রাগান্বিত হয়ে হামলা করে বাবা আদম শহীদের দরগায়। নৃশংস ভাবে তাকে শহীদ করা হয়।
পরবর্তীকালে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মুন্সিগঞ্জ বিজয় হয়।

[২]

১২০৩ সালে বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে বাংলা মুসলিমদের অধিকারে আসার পর সিলেটে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠেছে। ঠিক এর ১০০ বছর পর ১৩০৩ সালে সেখানের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান নিজ ছেলের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করে হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন। এ কারণে, গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশুপুত্রকে হত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তৎকালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরোজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তাঁর ভাগ্নে সিকান্দর গাজীকে তার বাহিনীসহ সিলেটে প্রেরণ করেন।
কিন্তু রাজা গৌর গোবিন্দের জাদুর কারণে তারা পরাস্ত হন।
পরবর্তীতে গাজী সূফী শাহ জালাল (রহ.) এর মাধ্যমে সিলেট মুসলিমদের অধীনে আসে।

[৩]

সম্রাট আকবর “দ্বীন এ এলাহি” চালু করায় হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার্থে গরু জবাই সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ আরোপ করে।
মুজাদ্দিদে আলফে সানীর সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে একটির ছিল গরু জবাই সংক্রান্ত বিধি নিষেধ আরোপকে বাতিল করা।
কিন্তু আকবর করেনি, পরবর্তীতে আকবরের সিলসিলায় জাহাঙ্গীর বাদশাহ হন ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে।
মুজাদ্দিদ কে জাহাঙ্গীর, গোয়ালিয়র দূর্গে বন্দী করেন। তাতে সাম্রাজ্যের আনাচে কানাচে বিদ্রোহ দেখা দিলে সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে মুক্তি দেন, এবং পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁরই মুরিদ (student) হন এবং মুজাদ্দিদের আদেশ অনুসারে গরু জবাই এর বিধি বিষেধ বাতিল করেন।

[৪]

আরবি ফারাইজ হচ্ছে ফরিজাতুনের বহুবচন। ফারিজা বা ফরজ মানে হচ্ছে অবশ্য পালনীয়। ফরায়েজী আন্দোলন মূলত ইসলামের অবশ্যপালনীয় কর্তব্যে মুসলিমদের অনুশীলন নিশ্চিত করতে জোর দিচ্ছিল।
সে আন্দোলনের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু জমিদারদের চাপিয়ে দেয়া গরু জবাই নিষিদ্ধের বিধান উঠিয়ে নেয়া।

[৫]

জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার না পাওয়ায় ১৮৩১ সালের ৬ ই অক্টোবর শেখ মাসুমের নেতৃত্বে তিতুমীরের প্রায় তিনশত শিষ্য কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করেন।
খবর শুনে কৃষ্ণদেব বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়।বাড়ির ছাদ হতে তিতুমীরের দলের উপর অজস্র ইট বর্ষণ করায় তিতুমীরের দল বেশি সুবিধা করতে পারেনি।
ফেরার পথে বারোয়ারী তলার মন্দিরের কাছে এসে একটা গরু জবাই করে এবং গরুর রক্ত মন্দিরে নিক্ষেপ করে। এই ঘটনার জের ধরে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়,এবং পরবর্তীতে চব্বিশ পরগণা থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ইসলামিক রাষ্ট্র তৈরি হয়।

[৬]

উপমহাদেশে হিন্দু এবং মুসলিম দুটি আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার পেছনেও গরু জবাই একটি অন্যতম কারণ।
৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান সময়েও বাংলার কিছু কিছু জায়গায় গরু কুরবানী করতে ভয় পেতো। ১৯৫৭ সালে নাটোরের পর ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর এই অঞ্চলে নিয়মিত গরু কুরবানি দেওয়া শুরু হয়।
এ প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারেঃ

[৭]

যাই হোক,এবার একটু অনেক পিছনে যাই;
ইহুদীদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের ইহুদী ধর্মে তারা উট খেত না এবং শনিবারকে পবিত্র জ্ঞান করতো। যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ উট খাওয়া থেকে বিরত থাকতো এবং শনিবারে রোজা রাখতো ও নফল ইবাদত বেশি করতো। এটা তাদের পূর্বের ধর্মের অনুরাগ থেকেই করতো। তাদের এই আচরণ আল্লাহ পছন্দ করেন নি।
তাদের উদ্দেশ্যে সূরা বাকারার ২০৮ ও ২০৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের স্পষ্ট শত্রু। অতএব তোমরা যদি সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পদস্খলিত হও তবে জেনে রাখো, আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান।

চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আলিম অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের উট খেয়ে মুসলিম হতে বলেছেন। যারা ইহুদী তারা যদি মুসলিম হয় তবে তারা উট খেয়ে নিশ্চিত হতে হবে সত্য উপলব্ধি করার পর আগের ধর্মের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর নেই। তেমনি এদেশে যারা মুশরিক থেকে মুসলিম হবে তারাও গরু খেয়ে নিশ্চিত হতে হবে তারা এখন আর গরু কে তাদের মা মনে করেন না।
আর এ কারনে বাংলায় দাওয়াতী কাজে আসে আলিমরা এদেশের মানুষকে গরু জবাইতে অভ্যস্ত করে তুলেছেন। যাতে তারা পরিপূর্ণভাবে মুসলিম হয়।

[৮]

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

যে ব্যক্তি আমাদের নামাজ আদায় করবে, আমাদের কেবলা অনুসরণ করবে এবং আমাদের জবাইকৃত পশু খাবে, সে হলো মুসলিম।সহিহুল বুখারী হাঃ ৩৯১, মুসলিম হাঃ ১৯৬১

গোবাছুর পূজাকারীর উপর আল্লাহ তায়ালা অভিশাপ দিয়ে বলেন,

নিশ্চয়ই যারা গো-বাছুরকে (উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদেরকে আক্রান্ত করবে তাদের রবের পক্ষ থেকে গজব ও লাঞ্ছনা।সুরা আ’রাফ : আয়াত ১৫২

এই ইতিহাস গুলো থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে,
গরু জবাই উপমহাদেশের হক-বাতিল এর একটা অন্যতম লড়াই ও নিদর্শন।
সুতরাং কেউ যদি গরু জবাই এর বিরুদ্ধে বলে সর্বসম্মতিক্রমে এর প্রতিবাদ করা উপমহাদেশের মুসলিমদের অন্যতম কর্তব্য।
আজ আপনি আপনার এই উত্তরাধিকার নাই হতে দেবেন, আগামীকাল তখন কালচারাল জমিদারদের হেজেমনির কারণে আপনিই নাই হয়ে যাবেন।
অতএব প্রশ্ন আপনার কাছে,

মুসলিম আইডেন্টিটি রক্ষার্থে আপনার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মুসলিম কালচারাল হেজেমনি রক্ষা করছেন তো?

তথ্যসূত্রঃ

  1. Afgani, A. (Jul 20, 2020). বাঙালিরা কেন বেশি গরু কুরবানী করে? http://www.ahmedafgani.com/2020/07/blog-post_28.html
  2. উপমহাদেশে মুসলিম পুনর্জাগরণ – অধ্যাপক মোঃ আবুল কাশেম ভূঁইয়া (ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত)
  3. গরু জবাই : মুসলমানদের কালচারাল আইডেন্টিটি, মুনাওয়ার হাসনাইন (Jun 27, 2023), আলাপন ব্লগ. https://alaponblog.com/post/6503/গরু-জবাই—মুসলমানদের-কালচারাল-আইডেন্টিটি
    Show More
    0 0 votes
    Article Rating
    Subscribe
    Notify of
    guest
    0 Comments
    Inline Feedbacks
    View all comments
    Back to top button