ইতিহাস

সতীপ্রথার জন্য কি মুসলিম শাসন দায়ী?

বর্তমানে নতুন একটা ন্যারেটিভ আনার চেষ্টা করা হচ্ছে যে,

‘সতীদাহপ্রথা ভারতে কোনকালেই ছিলোনা, এটার উদ্ভব হয়েছে মুসলমানদের আগমনের পর’

এরকম ফালতু কথাবার্তা অনলাইন ও বেশকিছু লেখক তাদের বইয়ে দাবী করেছেন (যেমন চৌথুপীর চর্যাপদ)। তো দেখা যাক ইতিহাস কি বলে…।

সতী বিষয়ক গবেষক গোরাচাঁদ মিত্রের মতে ‘সতীদাহপ্রথা ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতি এতে সন্দেহ নেই।’

তবে ভারতে সতীপ্রথার উদ্ভব কোন যুগে এটা নিয়ে বেশ তর্ক আছে পণ্ডিতদের মধ্যে, এটা বৈদিক যুগের নাকি বেদ পরবর্তী যুগের এনিয়ে মতপার্থক্য আছে। অবশ্য রাজা রাধাকান্ত দেবের মতে ঋগ্বেদে সতীপ্রথার উল্লেখ আছে। এনিয়ে উইলসনের সাথে তাঁর একটা তর্কও হয়।

কুমুদনাথ মল্লিক তার বই ‘সতীদাহ’-তে বলেছেন,

“বৈদিক যুগে আর্য্যগনের উর্ব্বর মস্তিষ্কে ইহার বীজ উত্তপ্ত হইয়াছিলো বেদ পাঠেই তাহা জানা যায়।”

তিনি আরো বলেন, “এই সহমরণ প্রথা ভারতে অতি প্রাচীন কাল হইতে প্রচলিত দেখা যায়। পৃথিবীর আদিম জ্ঞানভাণ্ডার বেদেও ইহার উল্লেখ দৃষ্ট হয়।

যাইহোক বেদ-পরবর্তী যুগে ভারতবর্ষে যে সতীদাহের প্রচলন ছিল সে বিষয়ে কোন মতদ্বৈধতা নেই। গোরাচাঁদ মিত্র লিখেন,

ভরদ্বাজ, অশ্বলায়ন প্রভৃতি বিভিন্ন সূত্রকারগণের ব্যাখ্যাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। রামায়ণ ও মহাভারতের পাতায় বেশ কয়েকটি সতীদাহ অনুষ্ঠানের সন্ধান মেলে। বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডে দেখি রাজা দশরথের মৃত্যুর পর রামের মা কৌশল্যা দেবী সহমৃতা হবার অভিলাষ ব্যক্ত করেছিলেন। সীতা দেবীও রামের অনুগামিনী হতে চেয়েছিলেন।[1]সতীদাহ, গোরাচাঁদ মিত্র, পৃ ১৪

মহাভারতে কিন্তু সতীদাহের ছড়াছড়ি। মাদ্রী দেবী স্বামীর সহগামিনী হয়েছিলেন। মহারাজা পান্ডুর মৃত্যুর পর স্ত্রী পতিব্রতা কুন্তীও সহমরণে যেতে ইচ্ছা করেন কিন্তু মাদ্রীর অনুরোধে সে ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন।[2]মহাভারত, আদিপর্ব, অধ্যায় ১২৫, অধ্যায় ৯৫

শ্রীকৃষ্ণের মৃতুর পর তাঁর পিতা বাসুদেব যোগালম্বন-পূর্বক আত্মহত্যা করলে, তার চার পত্নী দেবকী, ভদ্রা, রোহিণী ও মদিরা স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করেছিলেন। দাহকার্য সম্পন্ন করেছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন।[3]মহাভারত, মৌসলপর্ব, ৭ম অধ্যায়, শ্লোক ২৫-৩৬

গোরাচাঁদ মিত্র ও কুমুদনাথ মল্লিক পুরাণগুলোর শ্লোকসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এ বিষয়ে।

এবার পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক,

প্রসিদ্ধ গ্রীক ঐতিহাসিক ডিওডোরাস সিকিউলাসের লেখায় ভারতবর্ষের সতীদাহ অনুষ্ঠানের প্রথম বিবরণ চোখে পড়ে। খ্রীষ্টপূর্ব ৩১৪ সালে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় কাথি জাতির মধ্যে সহমরণের প্রচলন ছিল।

স্বপন বসু জানান,

সতীর আগুন কিন্তু রামমোহনের সময়ই প্রথম জ্বলে নি। ইতিহাসের পথ বেয়ে আমরা যদি পেছিয়ে যাই দেখব, অন্তত ২৩০০ বছর আগে থেকেই ভারতবর্ষে সতীর চিতা বহ্নিমান। খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজাণ্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন, তখনই ভারতবর্ষে এই প্রথা রীতিমতো প্রচলিত। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে পার্লাবে এ প্রথার প্রচলন ছিল।[4]সতী, স্বপন বসু, পৃ ২

ডিওডোরাস লিখেছেন,

তারপর আলেকজান্ডার কাথি রাজ্যে প্রবেশ করলেন, যেখানে আইনের সাহায্যে বিধবা নারীদের মৃতস্বামীর জলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মারা হত। কোন এক নারীর বিশ্বাসঘাতকতার জন্ম, যে তার স্বামীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিল, এই প্রথার উদ্ভব হয়।[5]এই ঘটনার তারিখ ১০৬ অলিম্পিয়াড অর্থাৎ পৃষ্ট পূর্ব্ব ৩১৪ বৎসর পূর্ব্বে। এই ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ Diodorus Siculus এর Narrative of the Expedition of Alexander the Great into India তে দ্রষ্টব্য, Also vide Good old days of … See Full Note

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় এদেশে যে সতীদাহের প্রচলন ছিল ঐ অভিযানের সঙ্গী অ্যারিস্টোবিউলাসের সাক্ষ্যেও তার প্রমাণ মেলে।

সিসিরো’র বিখ্যাত ‘টাসকিউলিয়ান ডিসপিউটেশনে’ ও গ্লুটার্কের ‘নীতিমালা’ গ্রন্থে ভারতীয় সতীদাহের উল্লেখ রয়েছে। আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে বিখ্যাত গ্রীক কবি প্রোপাসিয়াসের চোখে ভারতীয় সতীনারী সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতীকরণে প্রতিভাত হয়েছিলেন। মেগাস্থিনিসের বিবরণের ওপর নির্ভরশীল আনুমানিক তৃতীয় শতাব্দীর লেখক সলিনাস স্বামীর মৃত্যুর পর ভারতীয় নারীদের মধ্যে সতী হবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিজয়িনীর উল্লাস ও পরাজিতের বেদনার কথা উল্লেখ করেছেন। পঞ্চম শতাব্দীর লেখক স্টবিয়াস এ প্রথা সম্পর্কে প্রায় ঐ একই কথা বলেছেন। সমকালীন আর এক লেখক সার্ভিয়াসও ভারতীয় রাজাদের মৃত্যুর পর তার পত্নীদের মধ্যে সতী হবার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা লিখে গেছেন।

গোঁরাচাদ মিত্র বলেন,

সতীদাহ সম্বন্ধে আপাততঃ যা আলোচনা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্তসার হলঃ

  1. খ্রীঃ পূঃ ৫০ অব্দের পর ভারতবর্ষের সমাজজীবনে সতীদাহ প্রথার বহু অস্তিত্ব অনুভূত হয়।
  2. আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় (খ্রীঃ পূঃ ৩১৪ সালে) ভারতবর্ষের নামমাত্র ২০১টি দেশীয় রাজ্যে সতীদাহ প্রচলিত ছিল।
  3. রামায়ণ-মহাভারতের কালে সতীদাহ প্রথা বেশ কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিল।[6]সতীদাহ, গোরাচাঁদ মিত্র পৃ ১৯

সতীদাহ প্রথা কি ভারতবর্ষের নিজস্ব? না, বিদেশ থেকে আমদানী করা? কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে এই প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। শকরা এনেছিলো। কিন্তু গোরাচাঁদ মিত্র বিস্তারিত আলোচনা করে মত দিয়েছেন যে এটা সম্পূর্ণ ভারতীয়।[7]প্রাগুক্ত, পৃ ২৩

এখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য সেটা হলো হিন্দুদের সংস্পর্শ থেকে মুসলমানদের মধ্যেও এই অমানবিক প্রথা ঢুকেছিলো, অনেক মুসলিম নারী মৃত স্বামীর সাথে কবরস্থ হতো। স্বপন বসু এবিষয়ে আলোকপাত করেছেন।[8]সতী, স্বপন বসু, পৃ ৩০-৩১

এবার দেখা যাক সতীপ্রথা বন্ধের ফলে ততকালীন এর প্রতিক্রিয়া কি ছিলো…।

সতী নিবারণ করা হবে একথা শুনে ১৯/১১/১৮২৯ তারিখে ভবানীচরণ ‘সমাচার চন্দ্রিকা’তে লিখলেন,

আমাদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শিউরে উঠছে। আমরা বিপন্ন, ভীত, বিস্মিত। এমনকি অত্যাচারী মূললমান শাসকরাও আমাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করেন নি, কায়পরায়ণ কোনো সরকারের আমলে যদি তা করা হয়, তাহলে তারচেয়ে দুঃখের আর কি হতে পারে। মনে হচ্ছে, হিন্দুধর্মের শেষ অবস্থা উপস্থিত।[9]সতী, স্বপন বসু, পৃ ১৪১- ১৪২( বিস্তারিত)।

স্বপন বসু আরো জানিয়েছেন,

সতীপ্রথা নিষিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথেই ভবানীচরণ, সমাজপতি গোপীমোহন দেব, রাধাকান্ত দেব, কালীকৃষ্ণ দেব ইত্যাদিরা শলা-পরামর্শ করে গবর্নর জেনারেলের কাছে তাঁর প্রতিবাদ জানিয়ে সতী সমর্থকদের পক্ষ থেকে ১১৪৬ জনের স্বাক্ষর সমন্বিত দুটি আরজি পেশ করলেন। এই দুটি আরজির প্রথমটি কলকাতার ৬৫২ জন বিষয়ী ও ১২০ জন পণ্ডিত স্বাক্ষরিত। ব্যবস্থাপত্র, দ্বিতীয়টি বেলঘরিয়া, আড়িয়াদহ প্রভৃতি স্থানের ৩৪৬ জন বিশিষ্ট লোক ও ২৮ জন অধ্যাপকের স্বাক্ষরযুক্ত। আবেদনকারীদের বক্তব্য, সতীপ্রথা ধর্মীয়, এতে হস্তক্ষেপ অন্যায় ও অনায্য।[10]প্রাগুক্ত, পৃ ১৪৬-৪৭ (বিস্তারিত)।

এমনকি এ-প্রথা উঠে যাওয়ায় আনন্দিত চিত্তে রাজচন্দ্র তাঁর পত্নী রানী রাসমণিকে এ সংবাদ জানালে তিনি বলেন,

আমাদের দেশের কামিনীদের যেরূপ অবস্থা, তাহাতে তাহা প্রচলিত থাকাই ভাল।[11]The Brumho Shuba Meeting, Enquirer Nov. 13, quoted by The Calcutta Courier, 14.11. 1832.

মুসলিম শাসনামলে এবিষয়ে দৃঢ় কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি ধর্মীয় বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করা হবে ভেবে তবে আকবর, জাহাঙ্গীর এবিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আলমগীর আওরঙ্গেব ১৬৬৯ তে এক ফরমানে সতীপ্রথার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।[12]সতী, স্বপন বসু, পৃ ১০০

হিন্দুশাস্ত্রে সতীদাহ প্রথা, এবং সতীদাহের ইতিহাস নিয়ে আরো পড়তে পারেনঃ

    Footnotes

    Footnotes
    1সতীদাহ, গোরাচাঁদ মিত্র, পৃ ১৪
    2মহাভারত, আদিপর্ব, অধ্যায় ১২৫, অধ্যায় ৯৫
    3মহাভারত, মৌসলপর্ব, ৭ম অধ্যায়, শ্লোক ২৫-৩৬
    4সতী, স্বপন বসু, পৃ ২
    5এই ঘটনার তারিখ ১০৬ অলিম্পিয়াড অর্থাৎ পৃষ্ট পূর্ব্ব ৩১৪ বৎসর পূর্ব্বে। এই ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ Diodorus Siculus এর Narrative of the Expedition of Alexander the Great into India তে দ্রষ্টব্য, Also vide Good old days of John Company. p. 191.
    6সতীদাহ, গোরাচাঁদ মিত্র পৃ ১৯
    7প্রাগুক্ত, পৃ ২৩
    8সতী, স্বপন বসু, পৃ ৩০-৩১
    9সতী, স্বপন বসু, পৃ ১৪১- ১৪২( বিস্তারিত)।
    10প্রাগুক্ত, পৃ ১৪৬-৪৭ (বিস্তারিত)।
    11The Brumho Shuba Meeting, Enquirer Nov. 13, quoted by The Calcutta Courier, 14.11. 1832.
    12সতী, স্বপন বসু, পৃ ১০০
    Show More
    5 2 votes
    Article Rating
    Subscribe
    Notify of
    guest
    0 Comments
    Inline Feedbacks
    View all comments
    Back to top button