বৌদ্ধধর্মইতিহাসহিন্দুধর্ম

ব্রাহ্মণ্যধর্মের বৌদ্ধধর্মকে আত্মসাৎ করে ফেলার ইতিহাস

দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে তুর্কি মুসলমানদের দ্বারা বাঙ্গলা দেশ বিজিত হয় এবং সেসময় থেকেই বৌদ্ধদের নাম আর ইতিহাসে পাওয়া যায় না। প্রশ্ন হলো এই বৌদ্ধেরা গেলেন কোথায়? বহুজন এই বৌদ্ধদের না পাওয়ার দায় মুসলমানদের উপর চাপান, আসলেই কি তাই? নাকি অন্য কোন কারণ আছে।
এই প্রশ্নের সহজ একটা উত্তর হচ্ছে এই যে,

  • মুসলমানেরা ভারতীয়দের “বুদপরস্ত (মুর্তি উপাসক) হিন্দু” এই সাধারণ নামে আখ্যায়িত করত, এবং এই জন্য মুসলমান যুগের ইতিহাসে আর তাদের কোন আলাদা অস্তিত্বের সন্ধান মেলে না।[1]বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৫৩

  • গজনীর মামুদের দরবারী ঐতিহাসিক আল-বেরুনী বলেন-তিনি ভারতীয় বৌদ্ধদের সম্বন্ধে অনেক অনুসন্ধান করেছিলেন। তিনি শুনেছিলেন যে তাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের বিশেষ কলহ-বিবাদ আছে। কিন্তু তাদের (বৌদ্ধদের) দর্শন তিনি পাননি। বোধ হয় তাদের পৃথক সত্ত্বা তিনি ধরতে পারেন নি। অথবা তখন উহা ছিল না।[2]History Of Caste In India, S. V. Ketkar

  • উড়িষ্যাতে হিন্দুও ছিলো, বৌদ্ধও ছিলো। ব্রাহ্মণের প্রতিপত্তি ছিল, বিহারবাসী ভিক্ষুদেরও প্রতিপত্তি ছিল; কিন্ত রাজা হিন্দু হওয়ায় এবং রাজসভায় ব্রাহ্মণদিগের প্রতিপত্তি অধিক হওয়ায়, এবং মুসলমান ইতিহাসলেখকেরা হিন্দু ও বৌদ্ধের ভেদ করিতে না পারায়, উড়িষ্যা হিন্দুর দেশ বলিয়াই পরিচিত হইত।[3]বৌদ্ধধর্ম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সংস্করণ-১, পৃ ১০৮ https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.352664/page/n118/mode/1up?view=theater

অর্থাৎ বৌদ্ধদের আর কোন পৃথক অস্তিত্ব ছিলো না। তাদেরকে হিন্দু হিসেবেই ধরা হয়েছিলো অথবা….
ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছেন বৌদ্ধদের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার পিছনে মোটাদাগে দুটো কারণ আছে,

  1. ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মকে হজম করে ফেলা।
  2. বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণ করা।

ব্রাহ্মণ্য বা সেন যুগে নিম্নবর্ণ ও বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার হয়েছিল তাই তাদের একটা বৃহদাংশ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো,সেইসাথে বহুজনকে ব্রাহ্মণ্যধর্ম আত্মসাৎ করে আর কিছুজন থেকে যায় বৌদ্ধ হিসেবেই। তিনি লিখেন,

যেসব সহযানী বৌদ্ধ ছিলো তারাও বৈষ্ণব সহজিয়াদের মধ্যে মিশে যেতে লাগলো।[4]বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৬৭

এরপর লিখেন,

গণসাধারণ ও পতিতদের অনেকে সাম্যবাদীয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, আর অবশিষ্টের অনেকে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করলো বা পুরাতন বৌদ্ধ ধর্মকেই আঁকড়ে থাকলো তারপর যারা রইলো তারা অভিজাত শ্রেণির অন্তর্গত ব্রাহ্মণ্যবাদীয় তান্ত্রিক ধর্মাবলম্বী হয়েই রইলো।[5]বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত,পৃ ৬৯

ব্রাহ্মণ্যধর্ম কিভাবে বৌদ্ধ ধর্মকে হজম করে ফেলেছিলো এবিষয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেন যে,

বৌদ্ধধর্মের নিদর্শনগুলো ব্রাহ্মণেরা নাম পালটে তাঁদের নিজস্ব সম্পদ করে নেন। আর এ ভাবেই ক্ষেত্রপাল–ভৈরব, হারিতীদেবী–শীতলামাতা, এবং বৌদ্ধ ত্রিরত্ন–জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা রূপ পেলেন। অশ্বত্থ গাছ হয়ে উঠলো হিন্দু দেবতার আবাসস্থল। এমন কি “যজ্ঞ নিন্দা করেন” যে ধর্মঠাকুর তিনিও পাঁঠাবলি ভোগ সহযোগে ব্রাহ্মণদের দ্বারা পূজা পেতে লাগলেন। শেষে এই দুই ধর্ম এমনভাবে মিশে গেল যে এই মিশ্রণের মাঝখান থেকেই বাঙ্গলার বর্তমান হিন্দুধর্মের সৃষ্টি হলো।[6]সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অভিভাষণ বক্তৃতা

শাস্ত্রী মহাশয় আরও বলেন,

যখন একজন ব্রাহ্মণপূজক শিবপূজার সময় “ধেয়ঃসদা” ইত্যাদি মন্ত্র উচ্চারণ করেন তখন তিনি হিন্দু। যখন “আত্মানং বিষ্ণুস্বরূপাং বিভাজ্য” মন্ত্র উচ্চারণ করেন, তখন তিনি বৌদ্ধ।[7]প্রাগুক্ত

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথাগুলো উল্লেখ করে ভূপেন্দ্রনাথ বলেন,

…এ ভাবে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধ ধর্মের চিহ্ন পর্যন্ত বাঙ্গলাদেশ থেকে মুছে নির্মূল করে দেয়।[8]বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৬০

তাহলে এত এত বৌদ্ধ এরা গেলো কোথায় এর উত্তর খুব সোজা। ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এ বিষয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আলোচনা করে বলেছেন,

এককথায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু ও মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত হন। এই প্রকারে জৈনরাও সরাক নামে বাঙালি হিন্দু বলে পরিচিত হয়েছেন।[9]বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৬৪

ইসলাম গ্রহণ প্রসঙ্গে ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন,

… হিন্দু সমাজের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার হাত থেকে নিস্তার লাভের আশায় ভারতের পতিতেরা দলে দলে সাম্যবাদী নবধর্ম গ্রহণ করতে লাগল। ভারতের জাতীয় রাজশক্তি ও তৎপ্রতিষ্ঠিত সমাজ তাদের প্রতি কোনদিন ন্যায়বিচার করেনি সেজন্য এরা একবার আশ্রয় গ্রহণ করে বৌদ্ধধর্মে, আবার মুসলমান রাজশক্তি একটা সাম্যবাদীয় সমাজ-পদ্ধতির সুবিধা দেখানোর পর ছুটে চলে সেই দিকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, যেসব স্থান-গুলোকে ব্রাহ্মণেরা ত্রাতাদের দেশ আর বৌদ্ধপ্রধান দেশ বলে ‘ব্রাহ্মণ বজ্জিত’ স্থান হিসেবে ঘৃণা করত, সেই সব স্থান আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলমান প্রধান। মহাভারতের কর্ণপর্বে গান্ধার (পশ্চিম পঞ্জাব ও পূর্ব আফগানিস্থান), পঞ্চনদ, মদ্রক, সিন্ধু সৌবির (সিন্ধ) প্রভৃতি দেশসমূহকে ব্রাহ্মণদের বাসের অযোগ্য বলা হয়েছে। মনুতে উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী অধিবাসীদের ‘দরদ’ ও ‘ব্রাত্য’ বলা হয়েছে। আবার এদিকে বাঙ্গলাকেও বলা হয়েছে ব্রাহ্মণবর্জিত দেশ। কিন্তু এ সকল দেশই আজ মুসলমান প্রধান। অথচ মুসলমান আক্রমণকালে এসব দেশেই ব্রাহ্মণধর্মীয় রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। সুতরাং এর দ্বারা কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, এই সব দেশের বৌদ্ধ জনসাধারণ মুসলমান সাম্যবাদ গ্রহণ করেছে?[10]বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৫৭

আরো লিখেন,

যে কোন দেশের, বর্ণের বা জাতির লোক মুসলমান হলেই সে ইসলামীয় সমাজের মধ্যে স্বচ্ছন্দে স্থান পেয়ে থাকে। ইসলামের এই সাম্যবাদ বিজিত জাতিগুলির হৃদয় জয় করে এবং এর ফলে আরবদের দ্বারা বিজিত জাতের লোকেরা অনেক স্থলে প্রায়শই সম্পূর্ণভাবে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে নিত। এইচ. জি. ওয়েলস্ মহাশয় বলেন যে, ইসলামের অভ্যুত্থানের যুগে তদপেক্ষা উদার সমাজপদ্ধতি অন্য কোন সম্প্রদায় মানবজাতিকে উপহার দিতে পারেনি।…..ইসলামীয় সাম্যবাদ ভারতে খুব কার্যকরী হয়েছে সেজন্মে ভারতে মুসলমানের সংখ্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অপেক্ষা সর্বাধিক।…. বাঙ্গলা দেশের বেলায়ও সেই অনুমান করে বলা হয় যে পতিত জাতির ভেতর থেকেই বেশী সংখ্যায় লোক মুসলমান হয়ে পড়ে।[11]বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৫৬

চতুর্দশ শতাব্দীতে বার্বোসা নামে এক ইউরোপীয় পর্যটক এ বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, “বাঙ্গালীরা হুড় হুড় করে মুসলমান হচ্ছিল।”
[এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বাঙ্গলার ইতিহাসে’ বইয়ের ‘মুসলমান যুগ’ অংশটুকু পড়ুন]

    Footnotes

    Footnotes
    1বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৫৩
    2History Of Caste In India, S. V. Ketkar
    3বৌদ্ধধর্ম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সংস্করণ-১, পৃ ১০৮ https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.352664/page/n118/mode/1up?view=theater
    4বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৬৭
    5বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত,পৃ ৬৯
    6সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অভিভাষণ বক্তৃতা
    7প্রাগুক্ত
    8বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৬০
    9বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৬৪
    10বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৫৭
    11বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ ৫৬
    Show More
    0 0 votes
    Article Rating
    Subscribe
    Notify of
    guest
    0 Comments
    Inline Feedbacks
    View all comments
    Back to top button