রুক্মিণীর বিয়ের বয়স ১৬ নাকি ৮? কৃষ্ণ-রুক্মিণীর বিয়ে

কৃষ্ণের সাথে রুক্মিণীর যখন বিয়ে হয়েছিলো তখন রুক্মিণীর বয়স কত ছিলো?
হিন্দু অ্যাপোলোজিস্টরা তাদের একটি পেইজ পোস্ট করে দাবি করেছে,
আসুন দেখি তাদের দাবি কতটুকু সত্যি
১৬ বছর?
এক্ষেত্রে তারা হরিবংশ বিষ্ণুপর্বের রেফারেন্স টেনেছে।
হিন্দুসমাজে হরিবংশ বিষ্ণুপর্বের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

হিন্দুরাই বলছে হরিবংশ বিষ্ণুপর্ব প্রক্ষিপ্ত[1]বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণচরিত্র, পরিচ্ছদ ১৬ – WikiSource আবার তারাই সেখান থেকে রেফারেন্স দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে রুক্মিণীর বয়স ১৬ ছিলো ন্যুনতম। সুন্দর দ্বিচারিতা।
অনুবাদে জালিয়াতি
পাঠককে আমরা হিন্দি ফন্টে সংস্কৃত শ্লোকটি[2]Krishnakosh থেকে দেখাতে চাচ্ছি,
मरीचिमिव सोमस्य सौम्यां स्त्रीविग्रहां भुवि।
श्रीमिवाग्सयां विना पद्मं भविष्यां श्रीसहायिनीम्।
कृष्णेन मनसा दृष्टां दुर्निरीक्ष्यां सुरैरपि।।37।।श्यामावदाता स ह्यासीत् पृथुचार्वायतेक्षणा।
ताम्रौष्ठनयनापांगी पीनोरुजघनस्तनी।।38।।
সেই হিন্দু অ্যাপোলোজিস্টদের চ্যালেঞ্জ করা হলো এখান থেকে ১৬ কিংবা ১৬ জাতীয় কোনো শব্দ (ষোড়শ, ষোলতম ইত্যাদি) বের করে দেখাতে।
যারা অনুবাদে লুকোচুরির[3]আর্য সমাজদের বেদের অনুবাদে জালিয়াতি পর্ব ১, পর্ব ২
এই লেখাতেও তাদের জালিয়াতি দেখা যাবে জন্য এই ফিল্ডে বিখ্যাত তাদের একজনের অনুবাদ দেখুন,
kR^iShNena manasA dR^iShTAM durnirIkShyAM surairapi ||2-59-37
shyAmAvadAtA sA hyAsItpR^ithuchArvAyatekShaNA |She who was difficult to be seen even by deva-s, was seen by kR^iShNa with his mind. She was of sixteen years old. She was of white complexion. Her eyes were long and beautiful.[4]কে এস রামচরণ-এর অনুবাদ
http://mahabharata-resources.org/harivamsa/vishnuparva/hv_2_059.html

গোঁড়া পাঠক হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করতে নাও পারেন কারণ আমি বর্তমানে অহিন্দু। কিন্তু অপর হিন্দুলোকের কথা[6]Mahil Mehtar এর উত্তর দেখুন – Hindu StackExchange
আর্কাইভ লিংক বিশ্বাস করতেই পারেন,
আসুন Manmatha Nath Dutt (1897) এর অনুবাদ[7]A Prose English Translation Of Harivamsha, 1897, Page 500
বিকল্প টেক্সট লিংকঃ WisdomLib দেখি,
এখানে এই অনুবাদক জালিয়াতি করে ১৬ কিংবা এ জাতীয় কিছু আনেন নি। বাকিটা পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম।
নাকি ৮ বছর?
হিন্দুদের অন্যান্য উৎস থেকে দেখা যায় রুক্মিণীর বিয়ের বয়স ছিলো ৮ বছর।
স্কন্দপুরাণে রুক্মিণীর বিয়ের বয়স
হিন্দুদের বৃহত্তম পুরাণ হলো স্কন্দপুরাণ। স্কন্দপুরাণে[8]THE SKANDA-PURANA PART.15, Book 5, Khanda 3, Chapter 142, Verse 16-27
Page 405, MOTILAL BANARSIDASS PUBLISHERS PVT. DELHI উল্লেখ আছে,

বাংলা অনুবাদ[9]পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ
https://archive.org/details/skandapuram05vysa থেকে,

অন্য প্রকাশনী[10]প্রাগুক্ত, নবভারত প্রকাশনী থেকে,

শ্রীমদ্ভাগবতে রুক্মিণীর অবস্থা
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে[11]শ্রীমদ্ভাগবত, ১০ম স্কন্দ, ভার্স ৫০-৫২ এসেছে,

অর্থাৎ, রুক্মিণীর তখনো মাসিক হয় নি। তবে তার স্তন উৎপন্ন হচ্ছিলো। তিনি সবে মাত্র নবযৌবনে প্রবেশ করেছিলেন। আর বিজ্ঞান পড়ুয়ারা জানি মাসিকের ১-২ বছর আগেই মেয়েদের স্তন বাড়া শুরু করে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রুক্মিণীর বিয়ে ও সহবাস
ব্রহ্মপুরাণের অন্যতম অংশ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে[12]Brahma-vaivarta puranam. Translated into English by Rajendra Nath Sen, Page 500, কৃষ্ণজন্মখণ্ড, অধ্যায় ১১২, ভার্স ১-১০ আছে,

অর্থাৎ, রুক্মিণী তখনো ‘পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠে নি/নবযৌবনা’ যখন হিন্দুদের ভগবান কৃষ্ণ তার সাথে যৌনমিলন করে এবং তাতে চরমমুহূর্তে রুক্মিণী অজ্ঞান হয়ে পড়ে।[13]“রুক্মিণী দেহমিলনের আনন্দে সংজ্ঞা হারালেন।” – ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (পৃথিরাজ সেন), রেফারেন্সঃ প্রাগুক্ত
এটা এবং স্কন্দপুরাণের ৮ বছর পরস্পর সমর্থিত।
বঙ্গানুবাদেও[14]শ্রীপ্যারি মোহন গোস্বামী, সাং গোস্বামী দুর্গাপুর
https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.353667/page/n776/mode/2up সদৃশ কথা এসেছে।
Claim: বয়স কমানো হয়েছিলো?
সেই হিন্দু অ্যাপোলোজিস্টদের দাবি সেই সময়ে বয়স কমানো হচ্ছিলো। আসুন দেখি শুরুটাঃ
/* প্রাচীন ভারতে কীভাবে ও কখন বাল্যবিবাহ শুরু হলো এই প্রসঙ্গে আলোকপাত অতীব প্রয়োজন। আমরা এ বিষয়ে ভারতবর্ষের প্রাচীনকাল হতে আধুনিক সময় পর্যন্ত সম্পূর্ণ ইতিহাস নিয়ে লেখা ১১ খণ্ডের প্রাতঃস্মরণীয় গ্রন্থ “The History and Culture of the Indian People” এর সাহায্য নেবো। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার এই সিরিজটির সাধারণ সম্পাদক। তিনি ছাড়াও V. M. Apte, A. D. Pusalker, B. K. Gosh, H. D. Sankalia, S. Roy, A. K. Majumdar, P. M. Joshi, N. Venkataramanya, S. K. Chatterjee, S. K. Saraswati, J. N. Chaudhuri, G. S. Sardesai, A. L. Srivastava, Abdur Rashid and S. Roy এর মতো বিখ্যাত পণ্ডিতরা এই ১১ খণ্ডের লেখক হিসেবে ইতিহাসের প্যালিওলিথিক যুগ হতে বৈদিক যুগ হয়ে মৌর্য, শক,হুন, সালতানাত, মুঘল, ব্রিটিশ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত সকল ইতিহাস বর্ণনা করেছেন ভারতবর্ষের। বইটির ১ম খণ্ডে 392 নং পৃষ্ঠায় The Vedic Age বা বৈদিক যুগ সময়কালের বিয়েপ্রথা নিয়ে বলা হয়েছে… */
ক. ব্রাহ্মণদের রচিত ইতিহাস কেউই বিশ্বাস করে না। তাদের ভক্তরা বাদে। ব্রাহ্মণদের লেখা ইতিহাস আর পৌরাণিক কাহিনি একই কথা। ব্রাহ্মণদের লেখা ইতিহাস তাদের ধর্মীয় পৌরাণিক গাঁথা হিসেবে হিন্দুরা বিশ্বাস করতেই পারে। সেটা তাদের ব্যাপার।
খ. তাদের দেওয়া বইয়ে তাদের ঋগ্বেদ গ্রন্থের সাহায্যে ইতিহাস লেখা হয়েছে।[15]https://archive.org/details/vedicage00bhar/page/392/mode/2up বেদে কি ইতিহাস আছে? এটা কি সেই অ্যাপোলোজিস্টরা মানবে? কারণ তারা তো বেদকে চিরন্তন বলে বিশ্বাস করে। যদিও বৈষ্ণবরা তাদের বেদগ্রন্থকে নিজেদের ইতিহাস মনে করে। বিস্তারিত পড়ুনঃ
গ. বৈদিক যুগ বলতে কিছুই নেই। এটা জাস্ট হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত একটা মিথ। পৌরাণিক ভ্যাল্যুর বেশি কিছু নয়। তবে হিন্দুরা বৈদিক যুগ বলতে সেই সময়টার কথা বিশ্বাস করতে পারে যখন আর্য উপজাতিরা এদেশে ঘাটি গেড়ে আদিবাসীদের সাথে লড়াই করছিলো, আর পারসিক দেবতা ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে নতুন নতুন বেদ মন্ত্র রচনা করতো।
ঘ. ঋগ্বেদের কোনো ঐতিহাসিক ভ্যাল্যু নেই। এটা নিছক হিন্দুদের সর্বোচ্চ বিশ্বাস যে এটা তাদের ইতিহাস গ্রন্থ। বস্তুত, এটা পৌরাণিক কথাকাহিনি ছাড়া কিছুই নয়। আচ্ছা তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম আমি ঋগ্বেদের ঐতিহাসিক ভ্যাল্যু রয়েছে। কিন্তু তাহলে সেটা বিকৃত ও আংশিক ইতিহাস ছাড়া কিছুই হবে না। কারণ বেদের বহু বিলুপ্তি ও বিকৃতি ঘটেছে হিন্দুধর্মগ্রন্থ মতেই। এজন্য পড়ুনঃ
ঙ. এর পরেও তারা (সেই ঐতিহাসিকসহ) আদৌ সেই রেফারেন্স দিয়ে কিছু প্রমাণ করতে পেরেছে কি? সেখানে Red herring fallacy[16]https://www.techtarget.com/whatis/definition/red-herring ছাড়া কিছুই ছিলো না। পাঠক তাদের সব রেফারেন্স মিলিয়ে দেখেন না, এটাই পাঠকের দুর্বলতা। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক, হাজার বছর ধরে শুদ্র-পাজিতদের এসব পাঠ তো নিষিদ্ধ! অ্যাপোলোজিস্টরা ব্রহ্মচর্যর রেফারেন্স দিয়ে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ বলে। এটা Category Error Fallacy.[17]https://psychology.fandom.com/wiki/Category_error#:~:text=For%20the%20fallacy%2C%20see%20fallacy,not%20possibly%20have%20that%20property.ব্রহ্মচর্য করা অবস্থায় কাম নিষিদ্ধ সবারই জানা। ওদিকে অন্য ঐতিহাসিকরা বলেন[18]Why Did Vedic India Follow Child Marriage? – The Male Factor, 2018/1/4, “যারা ব্রহ্মচর্য করতো” তারা সাধারণত বিয়ের পরেই (even under age of 8) ব্রহ্মচর্য করতে যেতো, শেষ করে এসে তারা পূর্বে বিবাহিত স্ত্রীর সাথে সংসার শুরু করতো, এমনটাও হয়। অ্যাপোলোজিস্টরা তাদের বেদ গ্রন্থের ট্র্যাডিশনাল অর্থ বাদ দিয়ে নতুন নতুন অর্থ বানাচ্ছে আর সেটা তাদের ইতিহাস দাবি করছে, খুবই হাস্যকর। বেদের বাল্যবিবাহের নিষিদ্ধতার মন্ত্রগুলো কম্পেয়ার করি আসুন, কীভাবে আজগুবি ভার্স বের করা হয়েছেঃ
চ. হিন্দুদের ও প্রাচীন বিবাহের আনসেন্সর্ড ইতিহাস জানতে পড়ুন এই বইটি।[19]ভারতে বিবাহের ইতিহাস, ড. অতুল সুর https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.266522
যদি বয়স কমিয়ে বাল্যবিবাহ বাধ্যতামূলক করা হয়ে থাকে?
তর্কের খাতিরে এটা ধরে নিলেও, তাদের আরেকটি দাবি হলো, হিন্দুধর্ম একক ব্যক্তিপ্রদত্ত নয়, বিভিন্ন জন এসে হালনাগাদ করে দিয়ে গেছেন। তাহলে সেই দাবিমতে সেই বিধানও সবই হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত। আপনার ৩ হাজার বছর আগের রুলে থাকলেও এরপর থেকে যেটা পালিত হয়ে আসছে সেটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। দায়ও আপনার। নিজের ধর্ম সংশোধন করবেন নাকি করবেন না সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু পূর্বের দায় এড়ানোর উপায় নেই।