হিন্দুধর্ম

রামায়ণ আদিকাব্য ও বাল্মীকি আদি কবি কিনা?

রামায়ণ আদিকাব্য ও বাল্মীকি আদি কবি কিনা?

এই প্রবন্ধটি একজন হিন্দু লেখক কেদারনাথ মজুমদার (১৮৭০ – ১৯২৬) এর “রামায়ণের সমাজ” বইয়ের পৃ ৮-১১ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, ফ্রম মুসলিমস্‌ এর নিজস্ব অবস্থান নয়।

রামায়ণ আদি কাব্য এবং তাহার রচয়িতা মহর্ষি বাল্মীকি আদি কবি- এই দুইটী কথাই দুইটী সত্যসিদ্ধান্তের ন্যায় স্মরণাতীতকাল হইতে আমাদের মনে আধিপত্য বিস্তার করিয়া আসিতেছে। এইরূপ বিশ্বাস আমাদের মনে এবং সমাজের মনে জাগ্রত থাকিবার যে কোন কারণ নাই, তাহা নহে; প্রচলিত রামায়ণগুলিতেই এই দুইটী কথা স্পষ্টাক্ষরে স্বীকৃত হইয়াছে। লঙ্কাকাণ্ডের সর্ব্বশেষ সর্গে (১৩০ সর্গে ) এই দুইটী কথা, এইরূপ ভাবে আছে-

“ধর্ম্ম্যং যশস্যমায়ূষ্যং রাজ্ঞাঞ্চ বিজয়াবহম্ । আদি কাব্য মিদং চার্য্যং পুরা বাল্মীকিনা কৃতম।” (১০৫)

এই শ্লোকটী দ্বারা স্পষ্টই বিজ্ঞাপিত হইয়াছে যে, প্রাচীন (কবি) বাল্মীকির রচিত এই যে কাব্য ( রামায়ণ), তাহা আদি কাব্য।

এই শ্লোকটীর বিষয় নিবিষ্টভাবে চিন্তা করিলে, স্পষ্টই প্রতীতি হইবে যে ইহা কবি বাল্মীকির বহু পরবর্ত্তী কালের কোন লেখকের লেখনী প্রসূত।

কোন পদার্থকে “আদি” বলিয়া অভিহিত করিবার ভিতরই বহুর অস্তিত্বের ইঙ্গিত বিদ্যমান আছে, কেননা একাধিক পদার্থ বিদ্যমান না থাকিলে আদি, অর্থাৎ প্রথম বা দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি স্থান নির্দ্দেশ হইতে পারে না।

উপর্যুক্ত উক্তি, ‘পুরা বাল্মীকি’ বা ‘আদি কবি বাল্মীকি’ নির্দেশের বিরুদ্ধেও প্রযোজ্য হইতে পারে। জগতে একজন মাত্র কবি যতদিন থাকেন, ততদিন কেহ তাকে ‘আদি কবি’ বা ‘প্রথম কবি’ বলিয়া নির্দ্দেশ করে না; করিবার প্রয়োজনও হয় না। কোন কবিকে সমসাময়িক কবি বা লেখকগণও “পুরাকবি” বা ‘প্রাচীন কবি’ বা নির্দেশ করিতে পাবেন না। বহু পরবর্তী লেখকগণ বহু পূর্ববর্তী কবিকে না কবিদিগকেই ‘প্রাচীন’ বা ‘পুরা’ বিশেষণে বিশেষিত করিতে পারেন। সুতরাং রামায়ণকে আদি কাব্য বলিয়া এবং বাল্মীকিতে “পুরাকবি” বা “আদিকবি” বলিয়া যে নির্দেশ করা হইয়াছে—তাহা যে বাল্মীকির নিজ উক্তি নহে বা সমসাময়িক কোন লেখকেরও উক্তি নহে — ইহা মনে করা অসঙ্গত নহে।

এই নির্দেশ পরবর্ত্তী কোন কবির নির্দেশ হইলেই যে রামায়ণ আদি কাব্য ও তাহার রচয়িতা বাল্মীকি আদি কবি হইতে পারেন না, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাইতে পারে না। ইহার বিচার প্রয়োজন।

বিচার করিতে গেলে দেখা যার, ‘ভাগবত’ কার বাল্মীকিকে আদি কবি বলিয়া স্বীকার করেন নাই। তিনি ব্ৰহ্মাকে আদি কবি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। যথা —

“তেনে ব্রহ্মহৃদায় আদি কবয়ে।”

ভাগবতকার সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে কি অর্থে আদি কবি কল্পনা করিয়াছেন, আমরা তাহার ঐতিহাসিক বিচার এখানে করিব না; এস্থলে কেবল এই বলিয়াই এই উক্তি গ্রহণ করিব যে ভাগবতকার যখন এই শ্লোকটা প্রচার করিয়াছিলেন, তখনও বাল্মীকি যে আদি কবি, এই বিশ্বাস জনসমাজে  প্রচলিত ছিল না; অথবা থাকিলেও তাহা তেমন প্রতিষ্ঠালাভ করিতে সমর্থ হয় নাই। *[1]* সৃষ্টির উৎস যাহার নিকট অবস্থিত তিনি কবি, সৃষ্টির উপকরণ যিনি যোগাইয়া থাকেন তিনিও কবি, সৃষ্ট কর্ত্তাতো কবিই। এই হিসাবে ব্রহ্মাকে কবি বলা হয় নাই তো? … See Full Note

আদি কবি ব্রহ্মা কোন পৃথক কাব্য রচনা করিয়াছিলেন কি না, তাহার উল্লেখ আমরা কোন গ্রন্থে দেখিতে পাই না। রামায়ণের রচনার পূর্ব্বের কোন কাব্য গ্রন্থও এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। আবিষ্কৃত হয় নাই বলিয়াই যে ‘রামায়ণ’ আদি কাব্য হইবে, এ নির্দেশও অনেকে সমীচীন বলিয়া মনে করেন না । বহু মনীষী ব্যক্তিই রামায়ণের সরল সংস্কৃত ভাষা পাঠ করিয়া ইহাকে কার সাহিত্যের আদি রচনার নিদর্শন বলিতে কুণ্ঠিত। এরূপস্থলে ইহাই মনে হয় যে, রামায়ণ রচনার সময়কালে ক্ষুদ্র বৃহৎ আরও কাব্য রচিত হওয়া সম্ভব। তাহা কাল-বিপ্লবে নষ্ট হইয়াছে, কিন্তু সেই সকলের বহু উপকরণই রামায়ণ ও মহাভারতে গৃহীত হইয়াছে।

যাহা হউক, মহাকবি বাল্মীকি যে খুব প্রাচীন কবি, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। আবিষ্কৃত সংস্কৃত কাব্যসমূহের মধ্যেও যে রামায়ণ আদি কাব্য- প্রচুর মত ভেদ থাকিলেও আমরা এ কথা স্বীকার করিতেছি।

নিম্নের উদ্ভট শ্লোকটার কোন ঐতিহাসিক মূল্য না থাকিলেও ইহা বাল্মীকিকে প্রাচীনতম কবি বা আদি কবি নিয়া এক বচনে কবি শব্দের প্রয়োগে তাঁহাকেই নির্দ্দেশ করিয়াছে, ব্যাসের উদ্ভবে কবি শব্দের দ্বিবচনান্ত হইয়াছিল, অতঃপর দণ্ডির আবির্ভাবে কবি শব্দের বহুবচন সৃষ্ট হইয়াছিল ।

জাতে জাগতি বাল্মীকো কবিবিতা ভিবাহভবৎ। কবী ইতি ততো ব্যাসে কবরস্ততো দণ্ডিনি ॥

এই সকল উক্তিও যে বহু পরবর্ত্তী কল্পনার ফল, তাহা বলাই বাহুল্য।

    Footnotes

    Footnotes
    1* সৃষ্টির উৎস যাহার নিকট অবস্থিত তিনি কবি, সৃষ্টির উপকরণ যিনি যোগাইয়া থাকেন তিনিও কবি, সৃষ্ট কর্ত্তাতো কবিই। এই হিসাবে ব্রহ্মাকে কবি বলা হয় নাই তো? বাল্মীকির নামে যে অদ্ভুত রামায়ণ প্রচারিত আছে, তাহাতে কিন্তু এই ভাবের আভাস আছে। যথা, বাল্মীকি বলিয়াছেন,

    রামায়ণ মহারত্নং ব্রহ্মহৃৎক্ষারধাবভূৎ।
    নারদান্তং সমাসাদ্য ক্রমান্মম হৃদিস্থিতম্।
    তং সর্ব্বং ব্রহ্মণো লোকে নিঃশেষমবতিষ্ঠতে।” ২২/২৭ সর্গ

    অর্থ—এই রামায়ণরূপ মহারত্ন রক্ষার হৃদয়রূপ ক্ষীরসাগর হইতে উদ্ভুত হইয়াছিল, পরে নারদের অন্তরে থাকিয়া আমার (বাল্মীকির) হৃদয়ে স্থান লাভ করিয়াছে।

    Show More
    0 0 votes
    Article Rating
    Subscribe
    Notify of
    guest
    0 Comments
    Inline Feedbacks
    View all comments
    Back to top button