হিন্দুধর্ম

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

ভূমিকা

আজ আমরা আর্যসমাজীদের একটি চমৎকার মিথ্যাচারের জবাব দিবো। আর্যসমাজের লোকেরা বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ নিয়ে একটি বাল্যসুলভ কাউন্টার দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যার আদতে কোনো সত্যতা নেই। তো আসুন আমরা আমাদের মুল লেখাতে প্রবেশ করি।

আর্যসমাজীদের মিথ্যাচার

ফেইসবুক আর্য‌রা লিখেছে,

/* বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ তে কোনো প্রকার মাংস ভক্ষণের নিধান তো দূরের কথা বরং সেখানে কোনো মাংস ভক্ষণের কথায় নেই। সেখানে (১) যে ‘’মাংসৌদনং’’ শব্দ আছে তার অর্থ মাংস না বরং মাষ। কারন (২) বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.১৩.১ও২ আর (৩) গোভিল গৃহ্যসূত্র ২.৭.১-১৩, সেখানে মাংস কে মাষ ও তিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই সেখানে কোনো মাংস ভক্ষণের কথা নেই। */

সত্যিই আমি নিরাশ! আর্যসমাজের লোকদের পড়াশোনা দেখে। তারা যা বলেছে তা শতভাগই ভুল। আর আমি বলবো সে দাদারা বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬.৪.১৮ হয়তো বুঝতে পারে নাই কিংবা বুঝতে পারলেও তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে সত্য গোপন করেছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬.৪.১৮ তে কখনোই মাষ ও তিলের কথা বলে নাই সেটা আমরা প্রমাণ করবো তাদের দেওয়া রেফারেন্স থেকেই আর এটাও প্রমাণ করবো বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬.৪.১৮ তে অবশ্যই গোশত খাওয়ার বিধান আছে। তো আসুন আর দেরি না করি আমরা।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

অথ যে ইচ্ছেৎ পুত্রো মে পণ্ডিতো বিগীতঃ সমিতিংগমঃ শুশ্রুষিতাং বাচং ভাষিতা জায়েত সর্বান্বেদাননুব্রুবীত সর্বমায়ুরিয়াদিতি মাংসৌদনং পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তমশ্নীয়াতামীশ্বরৌ জনয়িতবা ঔক্ষেণ বার্ষভেণ বা।

অনুবাদঃ যে লোক ইচ্ছা করে যে, আমার পুত্র পণ্ডিত, দেশবিখ্যাত, সভাসদ্‌ এবং শ্রুতিপ্রিয় বচনভাষী হোক; এবং সে সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করুক, সম্পূর্ণ আয়ু লাভ করুক। [সেই লোক ও তাহার পত্নী] মাংসমিশ্রিত অন্ন পাক করিয়া ঘৃতযুক্ত করিয়া ভোজন করিবে। যৌবনাবস্থ  কিংবা ততোধিকবয়ষ্ক ষাঁড়ের মাংস দ্বারা [মিশ্রিত ওদন ভক্ষণ করিবে, তাহা হইলে, ঐরূপ পুত্র] সমুৎপাদনে সমর্থ‌ হয়।[1]বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ , ভাষ্যকারঃ আদি শঙ্করাচার্য

আর্যসমাজীদের তিনটা দাবি হলোঃ

  1. মাংসৌদনং শব্দের অর্থ মাষ ও তিল।
  2. আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.১৩.১ ও ২ তে বলা হয়েছে ‘’মাংসৌদনং’’ অর্থ মাষ ও তিল বা যব।
  3. গোভিল গৃহ্যসূত্র ২.৭.১-১৩ তে বলা হয়েছে মাষ ও তিল।

মাংসৌদনং শব্দের অর্থ কি মাষ ও তিল?

মাংসৌদনং শব্দের অর্থ কখনোই মাষ ও তিল না তা নিজেরাই দেখুনঃ

…ঔক্ষেণ বা আর্ষভেণ মাংসৌদনং পাচয়িত্বা…।

পদার্থঃ

  • (ঔক্ষেণ (৪).) গরু বা তরুণ গরু — বৃহদ্দেবতা ৪.৪১, পারস্কর গৃহ্যসূত্র ১.৩.২৮, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ৫.৩.৯১, ৪.২.৩৯,
  • (বা) অথবা —,
  • (আর্ষভেন (১).) গরু বা ষাঁড় গরু — উণাদি কোষ ৩.১২৩; নিরুক্ত ৯.২২.১; গোভিল গৃহ্যসূত্র ৩.৬.১২;  বৃহদ্দেবতা ১.১১১, ৮.১২,
  • (মাংস (২).) মাংস — নিরুক্ত ৪.৩.২১, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ৪.৪.৬৭, গোভিল গৃহ্যসূত্র ৩.১.২৩, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ২.৫.২,
  • (ওদনম (৩).) অন্ন — নিরুক্ত ৭.১৩.১৬, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ৪.৪.৬৭,
  • (পাচয়িত্বা) রান্না করিয়া — নিরুক্ত ২.১.২২.৫

বিশুদ্ধ অনুবাদঃ বাছুর বা তরুণ গরু অথবা বয়স্ক ষাড় গরু, মাংস মিশ্রিত অন্ন রান্না করিয়া…।

টীকাঃ

[১] ঋষভে রবাণে “– আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র ২.১৮.১৫

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

“অথ বৃষোৎসর্গ”শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র ৩.১১.১

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

মজার কথা হলো আর্যসমাজীদের মধ্যে বহু বেদভাষ্যকার বেদের ভাষ্য করতে গিয়ে ঋষভ শব্দের অর্থ ষাঁড় করেছেন। যেমনঃ

  • যজুর্বেদ ১৮/২৭ – দেবী চাঁদ, তুলসী রাম শর্মা, সত্যপ্রকাশ সরস্বতী, দয়ানন্দ সরস্বতী
  • অথর্ববেদ ৯/৪/১ – তুলসীরাম শর্মা, সত্যপ্রকাশ সরস্বতী, বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার (টীকা অংশ)
  • অথর্ববেদ ১৯/৩৬/৫ – সত্যপ্রকাশ সরস্বতী, হরিশহরণ সিদ্ধান্তলঙ্কার
  • অথর্ববেদ ১৯/২৭/১ – সত্যপ্রকাশ সরস্বতী, বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী, দেবী চাঁদ, ক্ষেমকরন দাস (সংস্কৃত ভাষ্যে মন্তব্য)
  • অথর্ববেদ ৫/২০/২ – বিশ্বনাথ, তুলসীরাম, সত্যপ্রকাশ, বৈদ্যনাথ, দেবীচাঁদ ইত্যাদি।
  • যজুর্বেদ ১৪/৯-১০ – দয়ানন্দ সরস্বতী

[২] “অহোরাত্রং ব্রহ্মচর্যমু পেত্যাচার্যোহ মাংসাশী”শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র ৬.১.২

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

মাংসাশন শ্রাদ্ধসূতক ভোজনেষু”শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র ৬.১.৭

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

[৩] ওদনং কৃসরং পায়সম্”আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ২.৪.৩

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

ওদনং কৃসরং পায়সং দধিমস্থান্ মধুমন্থাংশ”আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ২.৫.২

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

[৪] ঔক্ষেণ বা উক্ষণ শব্দের অর্থ ষাঁড় গরু – বৃহদ্দেবতা ৫.৩১

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

এছাড়াও আর্যসমাজীদের বেদের অনুবাদেও ঔক্ষেণ শব্দের অর্থ গরু পাওয়া যায়ঃ

  • যজুর্বেদ ২০.৭৮, ১৮.২৭ – দয়ানন্দ সরস্বতী

আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.১৩.১-২ তে কি বলা হয়েছে যে ‘’মাংসৌদনং ‘’ অর্থ মাষ ও তিল বা যব?

আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.১৩.১-২ কখনোই বলে নি যে বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬.৪.১৮ তে মাষ ও তিলের কথা বলেছে। এটা সম্পূর্ণ ভাবে আর্যসমাজী প্রোপাগাণ্ডা। কারন আমরা যদি দেখি আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.১৩.১ তে আচার্য অমরকুমার চট্টোপাধ্যায় বিবৃতির শেষের দিকে গিয়ে শুধু মাত্র বলেছেন,

বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ তে গর্ভাধান প্রভৃতি বিষয়ে কিছু আলোচনা পাওয়া যায়।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

আর আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.১৩.২ তে বলা হয়েছে,

যদি এই উপনিষদ না পড়া থাকে, তাহলে উপবাসকারী পত্নীর কল্যাণে গর্ভের তৃতীয় মাসে তিষ্যনক্ষত্রযুক্ত দিনে দুটি মাষের দানা ও একটি যবের দানা মেশানো দই খাওয়াবেন।

লক্ষ্য করুন, এখানে কিন্তু কোথায় বলা হয়নি যে ‘’মাংসৌদনং’’ অর্থ মাষ ও তিল বা যব। বরং আমরা একটু ভালো ভাবে লক্ষ করলে দেখতে পায় সেখানে বলা হয়েছেঃ (যদি এই উপনিষদ না পড়া থাকে) অর্থাৎ এখানে বলা হয়েছে বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ তে যে মাংস ভক্ষণ করে সন্তান লাভের একটি বিধান আছে সেটা যদি কারোর জানা না থাকে বা পড়া না থাকে তাহলে সে বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ এর বিধানের বিকল্পে যেটা করবে তাহলোঃ

উপবাসকারী পত্নীর কল্যাণে গর্ভের তৃতীয় মাসে তিষ্যনক্ষত্রযুক্ত দিনে দুটি মাষের দানা ও একটি যবের দানা মেশানো দই খাওয়াবে।

আর উপনিষদে যে গরুর মাংস ভক্ষণের বিধান আছে সেটা আচার্য অমরকুমার চট্টোপাধ্যায় আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.১৩.২ এর বিবৃতিতে পরিষ্কার করেছেন, এখানে মাষকলাই আসলে গরুর অণ্ডকোষ ও যব আসলে গরুর লিঙ্গের প্রতীক। অর্থাৎ আসলে উপনিষদে গরুর গোশ্ত খাওয়ার কথাই আছে। সেটা জানা না থাকলে এ নিয়ম করতে হবে।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গরুর গোশত খাওয়ার শ্লোক নিয়ে ফেইসবুক আর্য‌দের ভণ্ডামি

সুতরাং এখান থেকেই পরিস্কার যে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.১৩.১-২ তে কোথাও বলা হয়নি যে ‘’মাংসৌদনং’’ শব্দের অর্থ মাষ ও তিল বা যব। আর আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র কখনোই মাংস কে মাষ বলতেই পারে না, যেখানে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের অন্য জায়গায় তিল আর মাংস আলাদা শব্দে এসেছে, যেমনঃ

  • আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ২.৫.২

গোভিল গৃহ্যসূত্র ২.৭.১-১৩ তে কি মাষ ও তিলের কথা বলা হয়েছে?

এটা একটি ডাহা মিথ্যা কথা আর্যসমাজীদের। কারন গোভিল গৃহ্যসূত্র ২.৭.১-১৩ তে কোথাও বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি। বরং আর্যসমাজের লোকেরা গোভিল গৃহ্যসূত্র ২.৭.১-১৩ উপনিষদের ব্যাখার নামে চালিয়ে দিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ওপেন চ্যালেঞ্জ রইলো আর্য সমাজিদের প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে যে গোভিল গৃহ্যসূত্র ২.৭.১-১৩ তে কোথায় ‘’মাংসৌদনং’’ শব্দ আছে আর কোথায় অর্থ অন্য কিছু করা হয়েছে, দেখাক পারলে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬.৪.১৮ এর সাথে গোভিল গৃহ্যসূত্র ২.৭.১-১৩ এর কোনো মিল তো দূরের কথা কোনো সম্পর্কই নেই। কারন দুটির দুই কাহিনি ও প্রসঙ্গ ভিন্ন। আর গোভিল গৃহ্যসূত্রের বিভিন্ন জায়গায় ‘’মাংস’’ কে ‘’মাংস’’ বলেই উল্লেখ করেছে দেখুন

  • গোভিল গৃহ্যসূত্র ৩.১.২৩
  • গোভিল গৃহ্যসূত্র ৩.৫.১০

তাই দয়ানন্দের অনুসারীরা যতই গোভিল গৃহ্যসূত্রের নাম ব্যবহার করে মাংস কে মাষ বানানোর চেষ্টা করুক না কেন শেষমেশ হাতেনাতে ধরাই খেতে হলো।

    Footnotes

    Footnotes
    1বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ৬.৪.১৮ , ভাষ্যকারঃ আদি শঙ্করাচার্য
    Show More
    5 1 vote
    Article Rating
    Subscribe
    Notify of
    guest
    0 Comments
    Inline Feedbacks
    View all comments
    Back to top button