ইতিহাস

ভারতে ইসলাম – মুহাম্মদ বিন কাসিম বনাম দাহির

ইসলাম ভারতে এসেছিল আরবীয় বণিকদের দ্বারা কেরলে যতদূর জানা যায়। এজন্যই ভারতের প্রথম মসজিদ কেরলে পাওয়া যায়।

কিন্তু তরবারির সাথে ইসলাম এসেছিল মুহাম্মদ বিন কাসিমের মাধ্যমে।

কারণটা কি ছিল? ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেন,

আরবীয়দের সঙ্গে ভারতীয়দের বাণিজ্য যেমন স্বাভাবিক চলছিল ৬৬৩ খৃষ্টাব্দের পরেও অর্ধশতাব্দী ধরে তেমনই ভাবে চলতে থাকে। বাণিজ্যের সূত্রে সিন্ধুনদের মোহানা থেকে সিংহল পর্যন্ত অর্থাৎ আরব সাগরের ভারতীয়- উপকূলবর্তী অঞ্চলে, প্রধানত বন্দরগুলিতে, ছোট ছোট মুসলিম বসতিও গড়ে উঠেছিল। শত্রুতার সূত্রপাত হলো ৭০৮ খ্রিষ্টাব্দে। ঐ সময় সিংহল থেকে এক জাহাজ ভর্তি মুসলিম রমণী ইরাকে যাওয়ার পথে দেবল নামক বন্দরের কাছে অপহৃতা হয়। সিন্ধুর রাজা দাহিরের কাছে ইরাকের শাসক হাজ্জাজ অপহৃতা রমণীদের প্রত্যার্পণের দাবি জানালে দাহির প্রত্যুত্তরে জানান যে অপহরণকারীরা যেহেতু তাঁর নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত জলদস্যু ভাই হাজ্জাজের দাবি পূরণে তিনি অক্ষম।[1]সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৫

পরে এই হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ভারত অভিযানে পাঠান অপহৃতা নারীদের উদ্ধারের জন্য। তো বোঝা যাচ্ছে মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভারত অভিযানের মূল কারণ ছিল জলদস্যুদের থেকে অপহৃত নারীদের উদ্ধার করা। যদিও আরো কিছু কারণ ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারত অভিযান করলে স্থানীয় বৌদ্ধরা তাকে সাহায্য করেছিলো, কারণ দাহিরের রাজত্বে বৌদ্ধরা ছিল নির্যাতিত।[2]ডি এন ঝাঁ, অ্যাগেইনস্ট কম্যুনালাইজিং হিস্ট্রি, সোশাল সায়েন্টিস্ট

এছাড়া দাহিরের বড় ভাই দাহারসিয়ারের সাথে তার সিংহাসন নিয়ে বিরোধ ছিল, দাহারসিয়ারের পক্ষের লোকজনও আরবদের সহায়তা করে।

ফলশ্রুতিতে দাহিরকে প্রাণ দিতে হয় ১৭ বছরের যুবক মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে।

এবার দেখা যাক সিন্ধু বিজয়ের পর মুহাম্মদ বিন কাসিমের সেখানকার জনসাধারণের সাথে ব্যবহার কেমন ছিল।

দাহিরের একজন মন্ত্রী ছিলেন, শিয়াকর। মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁকে স্বপদে বহাল রাখেন।[3]চাচানামা, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, পৃ ২১৮

তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন,

হে ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ আপনি ভূমি রাজস্ব আদায়ের যে পূর্বতন পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন তাতে কোনরূপ অত্যাচার হয়নি। প্রজাদের উপর রাজস্বের বোঝা চাপানো হয়নি। সেজন্য প্রজারা আনন্দে আছে। প্রজাপালন ও ইনসাফের আইন এইরূপ হয়ে থাকে।[4]জাকাউল্লাহ, তারিখে হিন্দুস্থান, খণ্ড ১, পৃ ২১২

এছাড়াও রাজা দাহিরের খুড়তুতো ভাই কাকাসকে তিনি মন্ত্রী পদ দিয়েছিলেন।

বিজিত এলাকার জনসাধারণের সাথে কীরকম ব্যবহার করা হবে এ বিষয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে জিজ্ঞেস করলে তিনি নির্দেশ দেন,

যেহেতু বিজিতরা এখন আমাদের জিম্মি, অতএব তাদের জীবন ও সম্পত্তিতে আমাদের হস্তক্ষেপ করার কোনও অধিকার নেই। সুতরাং তাদেরকে আপন আপন উপাস্যের মন্দির গড়তে দাও। স্বধর্ম পালনের জন্য কেউ যেন বাধা বা শাস্তি না পায়, স্বদেশে সুখে স্বচ্ছন্দে বসবাসে তাদের যেন কেউ কোনও বাধা না দেয়।[5]সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৬

মুহাম্মাদ বিন কাসিম এরপর ব্রাহ্মণ্যধর্মের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও ব্রাহ্মণদের ডেকে নির্দেশ দিলেন যে,

তারা নিজেদের মন্দির নির্মাণ করুক, মুসলমানদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করুক, তারা নির্ভয়ে থাকুক, নিজেদের অবস্থার উন্নতি করুক, দরিদ্র ব্রাহ্মণদের সাথে ভালো ব্যবহার করুক, তাদের পূর্বপুরুষদের প্রথা-রীতি পালন করুক, ব্রাহ্মণদের যে-রূপ দক্ষিণা দেওয়া হত তা এখনও দেওয়া হবে (আদায়কৃত রাজস্বের শতকরা তিন টাকা ব্রাহ্মণদের জন্য পৃথক করে রাখা হত, যাতে প্রয়োজনের সময় তাদের সাহায্য করা যায় এবং অবশিষ্ট অর্থ রাজকোষের অন্তর্ভুক্ত করা হত, তাতে কোনোরূপ আত্মসাৎ করা হত না)-এই সকল প্রথা প্রচলিত রাখা হবে।[6]ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড ১, পৃ ১৮৩; চাচানামা, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, পৃ ২৩৩

ব্রাহ্মণদের সকল কথা মেনে নেওয়ার সাথে সাথে মুহম্মদ বিন কাসিম এটাও ঘোষণা করলেন যে,

তাদের মন্দিরকে ঠিক সেইরকমই মনে করা হবে, যেমনটা ভাবা হয় সিরিয়া ও ইরাকের ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উপাসনাগৃহ এবং অগ্নিপূজকদের উপাসনাগার, তাদেরকে ইচ্ছামতো উপাসনা করার অনুমতি দেওয়া হল।[7]ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড ১, পৃ ১৮৬; চাচানামা, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, পৃ ২৩৩

উপরোক্ত কথাটা প্রফেসর ডি এন ঝাঁও বলেছেন।তিনি এটাও বলেছেন যে, বৌদ্ধরা কাসিমের বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। এখানে কোন বলপ্রয়োগের কথা শোনা যায়নি।[8]ডি এন ঝাঁ, এগেইন্সট কম্যুনালাইজিং হিস্ট্রি, সোশাল সায়েন্টিস্ট
সিন্ধু প্রদেশে বিন কাসিম কর্তৃক অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের কথা ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদও উল্লেখ করেছেন।[9]ঈশ্বরীপ্রসাদ, এ সর্ট হিস্টোরি অব মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া, পৃ ৩৬

মুহাম্মদ বিন কাসিম ব্রাহ্মণাবাদের ‘মুকাদ্দম’দের ‘রাণা’ উপাধিতেও ভূষিত করলেন।[10]ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড ১, পৃ ১৮৭;  চাচানামা, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, পৃ ২৩৩

    Footnotes

    Footnotes
    1সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৫
    2ডি এন ঝাঁ, অ্যাগেইনস্ট কম্যুনালাইজিং হিস্ট্রি, সোশাল সায়েন্টিস্ট
    3চাচানামা, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, পৃ ২১৮
    4জাকাউল্লাহ, তারিখে হিন্দুস্থান, খণ্ড ১, পৃ ২১২
    5সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৬
    6ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড ১, পৃ ১৮৩; চাচানামা, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, পৃ ২৩৩
    7ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড ১, পৃ ১৮৬; চাচানামা, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, পৃ ২৩৩
    8ডি এন ঝাঁ, এগেইন্সট কম্যুনালাইজিং হিস্ট্রি, সোশাল সায়েন্টিস্ট
    9ঈশ্বরীপ্রসাদ, এ সর্ট হিস্টোরি অব মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া, পৃ ৩৬
    10ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড ১, পৃ ১৮৭;  চাচানামা, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, পৃ ২৩৩
    Show More
    0 0 votes
    Article Rating
    Subscribe
    Notify of
    guest
    0 Comments
    Inline Feedbacks
    View all comments
    Back to top button