ইসলামবিরোধীদের প্রতি জবাবকুরআন

কুরআনে বার বার কেন একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে?

যখন আমরা কুরআন তিলওয়াত করি তখন প্রথম যে কয়েকটি জিনিস আমাদের চোখে ধরা পড়ে তারমধ্যে একটি হলো একই বিষয়ের বারবার পুনরাবৃত্তি।

আপনি কি জানেন যে  মূসা (আ.) এর কাহিনি কুরআনে ১৫টি সুরায় ১৫ বার বর্ণনা করা হয়েছে? এবং ঈসা (আ.) এর কাহিনি ৭টি ভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে? ইব্রাহিম (আ.) এর কাহিনি ৫ বার, আদম (আ.) এর কাহিনি ৫ বার এবং অন্যান্য নবি-রাসুলদের কাহিনি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অনেকবার বর্ণনা করা হয়েছে?

অনেক সময় আপনি দেখবেন হুবহু একই আয়াতের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এমনকি কখনো কখনো সেটা একই সুরার মধ্যেও হতে পারে। সুতরাং এখন প্রশ্ন হলো কেন এরকম ঘটনা ঘটে?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা কুরআনের পুনরাবৃত্তিকে দুইভাগে ভাগ করবোঃ

  1. একই শব্দের বা আয়াতের পুনরাবৃত্তি।
  2. অর্থের পুনরাবৃত্তি।

প্রথম ঘটনায় আপনি দেখতে পাবেন একটি পরিপূর্ণ আয়াত কিংবা আয়াতের একটি অংশ হুবহু একইভাবে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এটা একই সুরায় কিংবা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ যেটা আমরা দেখতে পাই সুরা কাফিরুনে যেখানে একই আয়াত হুবহু দুইবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছ একই সুরায়।

আর দ্বিতীয় ঘটনায় যেখানে অর্থের পুনরাবৃত্তি করা হয় সেখানে প্রধানত নবি-রাসুলদের কাহিনির পুনরাবৃত্তি করা হয়। এবং একই ঘটনা আপনি জান্নাত জাহান্নাম সম্পর্কিত আয়াতগুলোতেও দেখতে পাবেন। এখন এই পুনরাবৃত্তির উদ্দেশ্য কি?
এটা সত্য যে পুনরাবৃত্তি কোনোকিছু নিশ্চিত করতে কিংবা এর গুরুত্ব বুঝাতে সাধারণত ব্যবহার করা হয়ে থাকে তবে পুনরাবৃত্তি আসলে আরবি ভাষায় একটি সাহিত্যিক কৌশল বা হাতিয়ার, রূপক কিংবা উপমার মতো। যখন এটাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয় তখন এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয় এবং একে অলংকার শাস্ত্রের নিদর্শনও বলা যায়, যেটা হুবহু কুরআনের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে এটাকে অলংকার শাস্ত্রের নিদর্শন বলা যায়?

অর্থের পুনরাবৃত্তি

তাহলে চলুন উদাহরণস্বরূপ কুরআনে আদম (আ.) এর সৃষ্টির কাহিনির দিকে লক্ষ্য করা যাক। আদম (আ.) এর কাহিনি কুরআনে অনেক জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে বিশেষ করে  সুরা বাক্বারায়, সুরা আলে ইমরানে, সুরা আল আরাফে, সুরা ক্বাহফে। অবশ্যই কুরআনের অন্যান্য জায়গায়ও আদম (আ.) এর কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে তবে আমি এই সুরাগুলোকে নির্ধারণ করেছি আমার পয়েন্টগুলো তুলে ধরার জন্য।

আমার প্রথম পয়েন্ট হলো আদম (আ.) এর সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনা যেটা সুরা বাকারায় বর্ণিত আছে। এটা বর্ণিত আছে সুরা বাকারার ৩০-৩৯ নং আয়াত পর্যন্ত।

আমরা এই কাহিনি থেকে জানতে পারি যে আদম (আ.) কে এমন জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল যেটা ফেরেশতাদের কাছে ছিল না বা তারা তা অর্জন করতে পারবেনা। এই সম্পর্কিত আয়াত নিচে উল্লেখ করা হলো:

وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ کُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِکَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ هٰۤؤُلَآءِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۳۱﴾قَالُوۡا سُبۡحٰنَکَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۳۲﴾قَالَ یٰۤاٰدَمُ اَنۡۢبِئۡهُمۡ بِاَسۡمَآئِهِمۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَنۡۢبَاَهُمۡ بِاَسۡمَآئِهِمۡ ۙ قَالَ اَلَمۡ اَقُلۡ لَّکُمۡ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ غَیۡبَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۙ وَ اَعۡلَمُ مَا تُبۡدُوۡنَ وَ مَا کُنۡتُمۡ تَکۡتُمُوۡنَ ﴿۳۳﴾

আর তিনি আদমকে নামসমূহ সব শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। সুতরাং বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’। (৩১)

তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’।(৩২)

তিনি বললেন, ‘হে আদম, এগুলোর নাম তাদেরকে জানাও’। অতঃপর যখন সে এগুলোর নাম তাদেরকে জানাল, তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ ও যমীনের গায়েব জানি এবং জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা তোমরা গোপন করতে?’(৩৩)সুরা বাকারাহ ২:৩১-৩৩

এই কাহিনি থেকে আমরা আরেকটা বিষয় জানতে পারি সেটা হলো ইবলিসের অবাধ্যতা এবং কুফরি।

وَ اِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اسۡجُدُوۡا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ اَبٰی وَ اسۡتَکۡب٭۫ وَ کَانَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۳

আর যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদা কর’। তখন তারা সিজদা করল, ইবলিস ছাড়া। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার করল। আর সে হল কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।সুরা বাকারাহ ২:৩৪

এই সুরার পরের সুরায় বিশেষ করে সুরা আল ইমরান থেকে আমরা জানতে পারি যে আল্লাহ আদম (আ.) কে পিতা মাতা ছাড়া মাটি থেকে সৃষ্টি করেন এবং তাকে বলেন ‘হও‘ এবং তিনি  হয়ে গেলেন। এই সম্পর্কিত আয়াত নিচে বর্ণনা করা হলো:

اِنَّ مَثَلَ عِیۡسٰی عِنۡدَ اللّٰهِ کَمَثَلِ اٰدَمَ ؕ خَلَقَهٗ مِنۡ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهٗ کُنۡ فَیَکُوۡنُ ﴿۵۹﴾

নিশ্চয় আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মত, তিনি তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে বললেন, ‘হও’, ফলে সে হয়ে গেল।সুরা আলে ইমরান ৩:৫৯

তবে আমরা যদি সুরা আরাফের (১১-২৫) দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো যে আদম (আ.) এর কাহিনির একটা অংশ এই সুরাতেও বর্ণনা করা হয়েছে তবে এখানে আমরা নতুন আরেকটা বিষয়ের সাথে পরিচিত হই। আমরা জানতে পারি যে ইবলিসের অবাধ্যতার পিছনের উদ্দেশ্য ছিল তার অহংকার কিংবা দম্ভ। এই সম্পর্কিত আয়াত নিচে বর্ণনা করা হলো:

وَ لَقَدۡ خَلَقۡنٰکُمۡ ثُمَّ صَوَّرۡنٰکُمۡ ثُمَّ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اسۡجُدُوۡا لِاٰدَمَ ٭ۖ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ لَمۡ یَکُنۡ مِّنَ السّٰجِدِیۡنَ ﴿۱۱﴾قَالَ مَا مَنَعَکَ اَلَّا تَسۡجُدَ اِذۡ اَمَرۡتُکَ ؕ قَالَ اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡهُ ۚ خَلَقۡتَنِیۡ مِنۡ نَّارٍ وَّ خَلَقۡتَهٗ مِنۡ طِیۡنٍ ﴿۱۲﴾قَالَ فَاهۡبِطۡ مِنۡهَا فَمَا یَکُوۡنُ لَکَ اَنۡ تَتَکَبَّرَ فِیۡهَا فَاخۡرُجۡ اِنَّکَ مِنَ الصّٰغِرِیۡنَ ﴿۱۳﴾

আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদের আকৃতি দিয়েছি। তারপর ফেরেশতাদেরকে বলেছি, ‘তোমরা আদমকে সিজদা কর’। অতঃপর তারা সিজদা করেছে, ইবলিস ছাড়া। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।(১১)

তিনি বললেন, ‘কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছে যে, সিজদা করছ না, যখন আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি’? সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে’।(১২)

তিনি বললেন, ‘সুতরাং তুমি এখান থেকে নেমে যাও। তোমার এ অধিকার নেই যে, এখানে তুমি অহংকার করবে। সুতরাং বের হও। নিশ্চয় তুমি লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত’।(১৩)সুরা আল আ’রাফ ৭:১১-১৩

এখন যদি আমরা সুরা আল-ইসরার (৬১-৬৫) দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পারবো এখানেও আদম (আ.) এর কাহিনির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে তবে এখানে কাহিনিতে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করা হয়েছে। আদম সন্তানকে পথভ্রষ্ট বা ধ্বংস করার জন্য ইবলিস যে প্রতিজ্ঞা করেছিল তা আমরা এই সুরা থেকে জানতে পারি। এই সম্পর্কিত আয়াত নিচে বর্ণনা করা হলো:

وَ اِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اسۡجُدُوۡا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ قَالَ ءَاَسۡجُدُ لِمَنۡ خَلَقۡتَ طِیۡنًا ﴿ۚ۶۱﴾قَالَ اَرَءَیۡتَکَ هٰذَا الَّذِیۡ کَرَّمۡتَ عَلَیَّ ۫ لَئِنۡ اَخَّرۡتَنِ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ لَاَحۡتَنِکَنَّ ذُرِّیَّتَهٗۤ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿۶۲﴾

আর স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, ‘আদমকে সিজদা কর’, তখন ইবলিস ছাড়া সকলে সিজদা করল। সে বলল, ‘আমি কি এমন ব্যক্তিকে সিজদা করব যাকে আপনি কাদামাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন’?(৬১)

সে বলল, ‘দেখুন, এ ব্যক্তি, যাকে আপনি আমার উপর সম্মান দিয়েছেন, যদি আপনি আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময় দেন, তবে অতি সামান্য সংখ্যক ছাড়া তার বংশধরদেরকে অবশ্যই পথভ্রষ্ট করে ছাড়ব’।(৬২)সুরা আল-ইসরা ১৭:৬১-৬২

এর পরের সুরায় সুরা কাহাফ থেকে আমরা জানতে পারি যে ইবলিস কোনো ফেরেশতা ছিল না বরং সে জ্বীনদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সম্পর্কিত আয়াত নিচে বর্ণনা করা হলো:

وَ اِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اسۡجُدُوۡا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ کَانَ مِنَ الۡجِنِّ فَفَسَقَ عَنۡ اَمۡرِ رَبِّهٖ ؕ اَفَتَتَّخِذُوۡنَهٗ وَ ذُرِّیَّتَهٗۤ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِیۡ وَ هُمۡ لَکُمۡ عَدُوٌّ ؕ بِئۡسَ لِلظّٰلِمِیۡنَ بَدَلًا ﴿۵۰﴾

আর যখন আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর। অতঃপর তারা সিজদা করল, ইবলিস ছাড়া। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার রবের নির্দেশ অমান্য করল। তোমরা কি তাকে ও তার বংশকে আমার পরিবর্তে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে, অথচ তারা তোমাদের শত্রু? যালিমদের জন্য কী মন্দ বিনিময়!সুরা কাহাফ ১৮:৫০

উপরের উদাহরণগুলো দেখে আমরা বুঝতে পারলাম যে যদিও কুরআনে একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে তবুও আপনি এমন কোনো কাহিনি পাবেননা যেটা দুই জায়গায় ১০০ শতাংশ অভিন্ন বা হুবহু একইভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আপনি যখনই কাহিনিগুলো পড়বেন তখনই দেখতে পাবেন যে প্রতিটা কাহিনিতে প্রতিবার নতুন নতুন তথ্য যোগ করা হয়েছে এবং অবশেষে আপনি এই কাহিনির সম্পূর্ণ চিত্র দেখতে পাবেন যা আল্লাহ আমাদের উপর নাযিল করেছেন। সুতরাং এই কাহিনিগুলো একে অপরকে নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে প্রতিটি বর্ণনায় আল্লাহ ভিন্ন ধারণা এবং ভিন্ন উপসংহার তুলে ধরেন যা সেই প্রেক্ষাপটের সাথে পরিপূর্ণভাবে মিলে যায় যেখানে কাহিনিটি বর্ণনা করা হয়েছে। তাই তো আমরা দেখতে পাই এক জায়গায় এই কাহিনি ফেরেশতাদের উপর আদমের মহত্ত্ব বর্ণনা করে এবং অন্য জায়গায় এটি আমাদের অহংকার ও দাম্ভিকতা থেকে সতর্ক করে, আরেক জায়গায় এটি ইবলিস এবং আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তার পরিকল্পনা থেকে আমাদের সতর্ক করে।

কিন্তু এখানে অলৌকিকতার বিষয় হলো যে কুরআন দীর্ঘ ২৩ বছরে ধরে ধরে একটু একটু করে নাজিল হয়েছে তবুও এটি কোনো ভুল বা বৈপরীত্য ছাড়াই পুরোপুরি মিলে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কুরআনে কেন একজন নবীর কাহিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই জায়গায় বর্ণনা করা হলো না? এটা কি আরো বেশি যৌক্তিক ও উত্তম পদ্ধতি নয়?

এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের বুঝতে হবে যে কুরআন কোনো ইতিহাসের কিতাব নয় যেখানে ঘটনাগুলো কালানুক্রমিকভাবে বর্ণনা করা হবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। বরং কুরআন নিদর্শন এবং হেদায়েতের কিতাব। আরও একটি বিষয় হলো নবী ﷺ এবং তাঁর সাহাবীগণকে তাদের জীবনকালে অনেক সমস্যা, বাধা ও কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। কুরআন একটু একটু করে নাজিল করা হয়েছিল মূলত এই কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের হৃদয়কে সুদৃঢ় করা এবং তাদেরকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলার জন্য। এই বিষয়টা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে তুলে ধরেন,

وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَوۡ لَا نُزِّلَ عَلَیۡهِ الۡقُرۡاٰنُ جُمۡلَۃً وَّاحِدَۃً ۚۛ کَذٰلِکَ ۚۛ لِنُثَبِّتَ بِهٖ فُؤَادَکَ وَ رَتَّلۡنٰهُ تَرۡتِیۡلًا ﴿۳۲﴾

আর কাফিররা বলে, ‘তার উপর পুরো কুরআন একসাথে কেন নাযিল করা হল না? এটা এজন্য যে, আমি এর মাধ্যমে তোমার হৃদয়কে সুদৃঢ় করব। আর আমি তা আবৃত্তি করেছি ধীরে ধীরে।সুরা ফুরকান ২৫:৩২

তাই একটি সম্পূর্ণ কাহিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই সাথে বর্ণনা করা হলে কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও এভাবে সম্পূর্ণ ভাবে প্রকাশিত কাহিনির কিছু বিবরণ অপ্রাসঙ্গিক হবে এবং প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবেনা।

কিন্তু যখন এটি সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী একটু একটু করে নাজিল করা হবে এটি সর্বদা প্রাসঙ্গিক হবে এবং এর একটি প্রেক্ষাপট থাকবে। পূর্ববর্তী রসূলদের সাথে যা ঘটেছিল তা বর্ণনা করা ছিল নবী ﷺ এবং তাঁর সাহাবীদের সাহায্য করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

একই শব্দ বা আয়াতের পুনরাবৃত্তি

আচ্ছা বুঝলাম কুরআনে একই কাহিনি বা অর্থের দিক থেকে একই বিষয় কেন বারবার বর্ণনা করা হয়েছে কিন্তু কুরআনে হুবহু একই শব্দের বা আয়াতের বারবার পুনরাবৃত্তি কর হয়েছে কেন? এমনকি এটা অনেক সময় একই সুরার মধ্যেও ঘটে থাকে।

আচ্ছা চলুন তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর খোজা যাক। এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ যা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। একই শব্দ বা বাক্যের পুনরাবৃত্তি করা আরবি ভাষায় একটি সাহিত্যিক হাতিয়ার। এই সাহিত্যিক কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে কোন একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা বুঝানো হয় এবং এটার দ্বারা কোনো বিষয়কে নিশ্চিত বা পরিপূর্ণ করা হয়। কুরআনের ক্ষেত্রে হুবহু একই ঘটনা ঘটেছে। এই বিষয়টাকে আরো ভালোভাবে বুঝার জন্য আমি একটি উদাহরণ পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা বলেন:

قُلۡ یٰۤاَیُّهَا الۡکٰفِرُوۡنَ﴿۱﴾ لَاۤ اَعۡبُدُ مَا تَعۡبُدُوۡنَ﴿۲﴾لَاۤ اَنۡتُمۡ عٰبِدُوۡنَ مَاۤ اَعۡبُدُ ۚ﴿۳﴾وَ لَاۤ اَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدۡتُّمۡ ۙ﴿۴﴾لَاۤ اَنۡتُمۡ عٰبِدُوۡنَ مَاۤ اَعۡبُدُ ؕ﴿۵﴾لَکُمۡ دِیۡنُکُمۡ وَلِیَ دِیۡنِ ﴿۶﴾

  1. “বলুন, হে কাফিররা!
  2. ‘আমি তার ইবাদাত করি না যার ইবাদাত তোমরা কর।
  3. এবং তোমরাও তার ইবাদতকারী নও যার ইবাদত আমি করি।
  4. এবং আমি ইবাদতকারী নই তার যার ইবাদাত তোমরা করে আসছ।
  5. এবং তোমরাও তার ইবাদতকারী হবে না যার ইবাদত আমি করি,
  6. তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার।”সুরা আল কাফিরুন আয়াত ১০৯:১-৬

এই সুরাটা পড়লে আপনারা দেখতে পাবেন যে এখানে ৩ নং এবং ৫ নং আয়াতে একই বাক্য দুইবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে সেটা হলোঃ

لَاۤ اَنۡتُمۡ عٰبِدُوۡنَ مَاۤ اَعۡبُدُ ۚ﴿۳﴾

“এবং তোমরাও তার ইবাদতকারী নও যার ইবাদত আমি করি।”

এখানে আল্লাহ তার রাসুলকে নির্দেশ দিচ্ছেন এটা বলার জন্য যে তোমরা তার ইবাদত করোনা যার ইবাদত আমি করি। এটা দুটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে। প্রথম বিষয় হলো যে, এটা কাফেরদের প্রতি একটি পরিষ্কার বার্তা যে রাসুল ﷺ তাদের সাথে যোগ দিবেন না কিংবা তাদের সাথে কোনো আপোষ করবেন না।

দ্বিতীয় বিষয় হলো আমরা দেখি যে কীভাবে কাফেররা তাদের উপাস্য এবং উপাসনা পদ্ধতি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন করে  এবং তাদের দেবদেবীরাও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়।

কারণ ২নং আয়াতে আমরা দেখতে পাই যে  مَا تَعۡبُدُوۡنَ ( মা_তা’বুদু_ন) শব্দটা বর্তমান কালে (present tense) এ ব্যবহার করা হয়েছে এটা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে তারা বর্তমানে যার উপাসনা করে কিন্তু ৪ নং আয়াতে مَّا عَبَدۡتُّمۡ( মা _ আ’বাততুম.) শব্দটি অতীত কালে (past tense) এ ব্যবহার করা হয়েছে এটা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে তারা পূর্বে যার উপাসনা করতো কিংবা করে আসছে। এখানে মূল যে বিষয়টা বুঝানো হয়েছে সেটা হলো তাদের উপাস্য এবং উপাসনা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়।

তাই আল্লাহ ২ নং আয়াতের পর ৩নং আয়াতে এবং ৪নং আয়াতের পর ৫নং আয়াতে একই বাক্য রিপিট করে বুঝাতে চাইছেন রাসুল ﷺ এর বিশ্বাসের ধারাবাহিকতা এবং তার উপাস্য সর্বশক্তিমান আল্লাহ এমন একজন যিনি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হননা। এই কারণে তিনি ৩য় ও ৫ম আয়াতে একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যা তারা উপাসনা করতো এবং যা তারা উপাসনা করছে তার উত্তর একটাই:

“এবং তোমরাও তার ইবাদতকারী নও যার ইবাদত আমি করি।”
এই পুনরাবৃত্তি আমাদের উভয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে।

উপসংহার

কুরআনের পুনরাবৃত্তি এবং তার পেছনের প্রজ্ঞা এবং সৌন্দর্য নিয়ে যদি কেউ লিখতে শুরু করে তাহলে একটি বিশাল আকার পুস্তক রচনা করতে পারবে। আমি এই আর্টিকেলে কিছু উদাহরণের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত আকারে বিষয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। আল্লাহ কুরআনে কখনোই নিরর্থক কিংবা কোন কারণ ছাড়া একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করেননি। প্রতিটি পুনরাবৃত্তির পিছনে রয়েছে হিকমাহ এবং উদ্দেশ্য। আল্লাহ কুরআনে একটি শব্দ কিংবা একটি বর্ণমালারও অপচয় করেননি। বরং এর প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বর্ণমালায় রয়েছে আমাদের জন্য নিদর্শন এবং উপকারিতা।

Arabic 101 এর এই ভিডিয়ো অবলম্বনে এই লেখাটি লিখা হয়েছেঃ

    Show More
    5 2 votes
    Article Rating
    Subscribe
    Notify of
    guest
    0 Comments
    Inline Feedbacks
    View all comments
    Back to top button