সেক্যুলারিজমদর্শন

হার্ম প্রিন্সিপাল (ইসলাম বনাম সেক্যুলার সমাজ)

ইসলাম ও সেক্যুলার সমাজের মধ্যে পার্থক্য কি? অনেক পার্থক্যই তো আছে। ইসলাম বিদ্যমান এরকম সমাজে জিনা-ব্যভিচার বৃদ্ধি পায়না, অপরাধের সংখ্যা কম হয়,মানুষে মানুষে সম্প্রীতি থাকে, মানসিক প্রশান্তি বজায় থাকে অর্থাৎ কেউ ডিপ্রেশনে পরে না। অ্যাটলিস্ট বিগত ১৪শ বছরের ইতিহাস এটাই বলে। অন্যদিকে সেক্যুলার সমাজে এই ভ্যালুজগুলো থাকে না। এরপরও ইসলাম ও সেক্যুলারিজমের মাঝে একটি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান আর তা হলো অপরাধ এবং নৈতিকতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে।

ইসলামের আকিদা অনুযায়ী আল্লাহ সুবহানাল্লাহু ওয়া তা’য়ালা সর্বোচ্চ বিধানদাতা। তিনি মানবজাতির যে যে বিধান দিয়েছেন তাইই চূড়ান্ত এবং একে কখনোই কাস্টোমাইজ করা যাবেনা। তাছাড়া ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন হওয়ায় তা মানুষের ফিতরাহ এর সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে বিধি-বিধান আরোপে সেক্যুলারিজম মানুষকে সর্বোচ্চ বিধানদাতা মনে করে। তারা অপরাধ নির্ণয়ের জন্য হার্ম প্রিন্সিপাল নামক ফিলোসফির আশ্রয় নেয়। আর এজন্যই সময়ের সাথে সাথে সেক্যুলারিজমের মোরালিটির পরিবর্তন ঘটে, পূর্বে অপরাধ ছিলো এমন কাজকে আর অপরাধ বলা হয়না। যেমন আশির দশকেও আমেরিকায় সমকামীতা ছিলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্মীয় ভ্যালুজ আর নর্মসের কারণে তৎকালীন সময়ে সেক্যুলার হওয়া সত্ত্বেও মানুষ সমকামীতাকে জঘন্য অপরাধ মনে করতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যখন খ্রিষ্টিং ভ্যালুজ আর নর্মস বিদায় নিতে শুরু করে তখনই তারা সমজামিতাকে অপরাধের খাতা থেকে বাদ দেয়।আর এখন তো পরিস্থিতি এমন যেন সমকামী না হওয়াই অপরাধ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো খ্রিষ্টবাদকে সর্বোচ্চ মনে করে,খিষ্টবাদের বিধানকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া পশ্চিম কিভাবে ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ বিধানদাতায় পরিণত করলো? কিভাবেই বা তারা হার্ম প্রিন্সিপালকে অপরাধ ও নৈতিকতা নির্ণয়ের মূলনীতি হিসেবে নিলো?

হার্ম প্রিন্সিপাল (ইসলাম বনাম সেক্যুলার সমাজ)

হার্ম প্রিন্সিপালের উৎপত্তি সেক্যুলারিজম থেকে। আধুনিক একাডেমিকরা সেক্যুলারিজমের উত্থানের জন্য যে ইতিহাস ব্যাখ্যা করে তা সহজ ভাষায় বললে মধ্যযুগে খ্রিষ্টপ্রধান ইউরোপে সকল কর্তৃত্ব ছিলো চার্চের উপর। একদিকে ইউরোপীয় ক্ষমতাসীন রাজা অন্যদিকে পোপগন,উভয়ের বিলাসিতা ছিলো চরম পর্যায়ের। একটি উদাহরণ দিলে তাদের বিলাসিতার ধরণ বুঝতে সহায়তা হবে, মধ্যযুগে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পণ্যের মধ্যে অন্যতম ছিলো মসলা। মসলার উৎপাদন সব স্থানে হতো না। এর জন্য প্রয়োজন উর্বর মাটি আর নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। এর পাশাপাশি মসলা বহন করাও বেশ ব্যয়বহুল ছিলো। সব মিলিয়ে বলতে গেলে স্বর্ণের দামেও মসলা বিক্রি হতো।[1]Spice: The History of a Temptation. (n.d.). Goodreads. https://www.goodreads.com/en/book/show/210364 তবে এত দাম হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপের বিলাসি রাজাগণ মসলাকে ভুলে যাননি। তাদের খাবারে প্রতিবেলায় স্থান পেতো গোলমরিচ, এলাচ, জাফরানের মতো দামি মসলায় তৈরি খাবার। প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব পোপগনও এই বিলাসিতায় আসক্ত ছিলো। আর তাদের মসলার এই ব্যয়ভার মিটতো জনগণের করের টাকায়। অথচ জনগণের অবস্থা তখন নাজেহাল। ”লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি” বইতে লেখক তৎকালীন আন্দালুস এবং ইউরোপের মাঝে বেশ পার্থক্য তুলে ধরেছেন। আন্দালুসের রাস্তায় রাতের বেলা যখন স্ট্রিটলাইট জ্বলতো তখন ইউরোপে জনসাধারণের টয়লেট পর্যন্ত ছিলোনা। এছাড়া ক্ষমতার লোভে রাজাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি এবং জনগণের বলি হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু ছিলোনা। আর প্রতিটা যুদ্ধই ছিলো বিলিফের জন্য। তবে উইলিয়াম টি ক্যাভানাফ তার বইয়ে যুদ্ধগুলোকে রাজাদের নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধ বলেছেন এবং সাধারণ ধার্মিক খ্রিষ্টানদের যুদ্ধে শামিল করার জন্য এগুলোকে ধর্মীয় যুদ্ধের নামে চালানো হয়েছে বলে ব্যক্ত করেছেন।[2]Cavanaugh, W. T. (2009, November 1). The Myth of Religious Violence. https://doi.org/10.1093/acprof:oso/9780195385045.001.0001

যুদ্ধ যে কারণেই হোক তার বাহ্যিক চিত্রই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। ইউরোপের নিজের যুদ্ধগুলো ধর্মীয় যুদ্ধ না হলেও জনসাধারণকে যুদ্ধে শামিল করতে যেহেতু ধর্মীয় ট্যাগ ব্যবহার করেছে সেহেতু জনসাধারণ ধরেই নিয়েছে যে যুদ্ধগুলো বোধহয় সত্যিই ধর্মীয় কারণে হচ্ছে। এই সময়ে কিছু দার্শনিকদের আবির্ভাব ঘটে যারা ধর্মকে সমস্যার মূল মনে করে। এক্ষেত্রে দার্শনিকদের আরেকটি শ্রেণি রাষ্ট্র হতে ধর্মকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ করার মতামত ব্যক্ত করেন। টমাস হবস এদের মধ্যে অন্যতম। আর এখান থেকেই মানুষ সেক্যুলারিজমের ধারণা লাভ করে।অবশেষে টমাস হবসের মৃত্যুর একশো বছর পর ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশনের মাধ্যমে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

সেক্যুলারিজম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ধর্মকে বাদ দেওয়ায় শুরু থেকেই কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়। আর এই সমস্যা আরও জোরদার হয় যখন ব্যক্তিগত জীবনেও ধর্ম গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। স্বাভাবিকভাবেই তারা এমন কিছু মৌলিক সমস্যার সম্মুখীন হয় যার সমাধান আগে বাইবেল থেকে নেওয়া হতো। আমাদের জীবনের লক্ষ কি (আধুনিককালে পাশ্চাত্যে এই প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খায় এবং পশ্চিমে ডিপ্রেশনের অন্যতম কারণ হলো এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না পাওয়া), আইন কিভাবে তৈরি হবে, নৈতিকতার উৎস কি ইত্যাদি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর মানবমস্তিষ্ক থেকে পাওয়া কোন সহজ বিষয় না।

১৮৫৯ সালে দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল তার অন লিবার্টি বইয়ে হার্ম প্রিন্সিপালের ধারণা দেন। হার্ম প্রিন্সিপাল অনুযায়ী একজন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধী না যতক্ষণ না সে অন্য কারও ক্ষতি করছে। সহজভাবে বললে,একজন মানুষ স্বাধীন এবং সে যা খুশি করতে পারে। তবে অন্য কারও ক্ষতি করতে পারবে না। কারও ক্ষতি করলে সে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন।[3]The Encyclopedia of Libertarianism. (2023, December 23). SAGE Publications Ltd. https://uk.sagepub.com/en-gb/eur/the-encyclopedia-of-libertarianism/book232698

বর্তমানে পাশ্চাত্যের নীতি-নোইতিকতার ধারণা পুরোটাই টিকে আছে হার্ম প্রিন্সিপালের উপর। যদিও সামাজিক বিজ্ঞান এথিক্স, নর্মস ইত্যাদির কথা বলে কিন্তু লিবারেল বয়ান অনুযায়ী ব্যক্তি প্রচলিত কোন মোরালিটি মানতে বাধ্য না। হার্ম প্রিন্সিপাল সাধারণ চোখে সত্যিই চমৎকার মূলনীতি। অ্যাটলিস্ট এমন মানুষদের চোখে যারা একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্কের বাহিরে চিন্তা করতে পারেনা, যাদের ফ্রেমওয়ার্ক পাশ্চাত্যের আদলে গঠিত।কিন্তু ন্যূনতম হলেও চিন্তা করতে চায় এরকম ব্যক্তির জন্য হার্ম প্রিন্সিপালের কারসাজি ধরা অত্যন্ত সহজ।

মনে করুন লিবারেলদের চোখের মনি আমেরিকার নেভাডায় একজন লোক ঘরে বসে গণবিধ্বংসী অস্ত্র বানাচ্ছে এবং রাষ্ট্র উক্ত লোকটি সম্পর্কে জানে। লোকটি যেহেতু শুধুমাত্র অস্ত্র বানাচ্ছে এবং কারও ক্ষতি করছে না সেহেতু সেক্যুলারিজমের চোখে এটা অপরাধ না। লোকটি ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধী বলে বিবেচিত হবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তা প্রয়োগ করছে। আর সে ভবিষ্যতে এটা ব্যবহার করবে এই প্রেডিকশনও তো দেওয়া যায়না। সুতরাং আদর্শ লিবারেল সেক্যুলার রাষ্ট্র সবকিছু জানা সত্ত্বেও উক্ত ব্যক্তিকে কোনোরূপ বাধাপ্রদান করবে না। সত্যি বলতে হরহামেশা যে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা শুনতে পাওয়া যায় তার প্রয়োগই ঘটছে এখানে।

আচ্ছা রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতার খাতিরে গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করা লোকটিকে বাধা না দিলে তা কি জনসাধারণের জন্য হুমকি স্বরূপ হবেনা? উক্ত ব্যক্তি যে সেই গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রয়োগ করবে না এরও তো কোন নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া সাধারণ জনগণ, যার কোন জবাবদিহিতা নেই, চেইন অফ কমান্ডে নেই এমন লোকের হাতে অস্ত্র দেওয়া খুবই বিপজ্জক। খোদ আমেরিকাতেই বেসামরিক জনগণ হালকা ধরনের আগ্নেয়াস্র ব্যক্তিগতভাবে রাখতে পারে কিন্তু এটাই আমেরিকার জন্য কাল। শুধুমাত্র ২০২১ সালেই আমেরিকায় বন্দুক সহিংসতায় ৪৮,৮৩০ জন মানুষ নিহত হয়েছে।[4]Pew Research Center. (2023b, April 26). What the data says about gun deaths in the U.S. | Pew Research Center. ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৩৯৪ বার স্কুলে বন্দুকধারী কর্তৃক হামলা হয়েছে।[5]Ulmanu, J. W. C. S. R. L. C. L. T. J. M. M. (2023, April 3). There have been 394 school shootings since Columbine. Washington Post. উক্ত আর্টিকেলটি লেখায় তিন দিন আগেও একটি স্কুলে হামলা হয়েছে যেখানে ১ জনের মৃত্যু এবং পাচজন ব্যক্তি আহত হয়।[6]1 killed, 5 injured by Iowa school shooter on the first day after winter break. (2024, January 5). NBC News. একজন বেসামরিক ব্যক্তির হাতে অস্ত্র দেওয়ার সমস্যা এখানেই। সেনাবাহিনীতে বাধা দেওয়ার জন্য চেইন অফ কমান্ড আছে কিন্তু সাধারণ জনগণকে বাধা দেওয়ার জন্য কোন চেইন অফ কমান্ড নেই। কাজেই তাদের হাতে অস্ত্র আসলে অপরাধ হওয়াটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে এমন লোকদের ক্ষেত্রে যাদের জীবনে স্রষ্টার কোন প্রভাব নেই।

কোন ব্যক্তি তার ঘরে বসে গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করলে রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যক তাকে অবশ্যই বাধা দেওয়া।কিন্তু তাকে বাধা দিলে তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হলো যা হার্ম প্রিন্সিপাল অনুযায়ী অপরাধ। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র তাকে বাধা দিতে চাইলে হার্ম প্রিন্সিপালের নীতি ভঙ্গ করে বাধা দিতে হবে। এই পয়েন্টে হার্ম প্রিন্সিপাল অকেজো। যদিও আমেরিকা এরকম লোককে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করবে এবং তাকে শাস্তির মুখোমুখি করবে কিন্তু একই আমেরিকা ব্যক্তি স্বাধীনতার খাতিরে সাধারণ জনগণের জন্য অস্ত্রের বৈধতা দিয়ে রেখেছে।

হার্ম প্রিন্সিপালের ক্রিটিকে উপরের পয়েন্টটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হতে পারে তবে এটা ছাড়াও এর আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফল্ট রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে যৌন উন্মাদনার বিষয়টি বেশ গুরুত্ববহ। হার্ম প্রিন্সিপাল অনুযায়ী যেহেতু মানুষ যা খুশি করতে পারে সেহেতু সে যার তার সাথে শুতে পারে, এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তির ইচ্ছা এবং কেউ এতে বাধা দিতে পারেনা। তবে কারও অনিচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক করলে তা নিশ্চয়ই উক্ত ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। তাই পশ্চিম এখানে কনসেন্ট বা “সম্মতির” বিষয়টি নিয়ে আসে। সহজভাবে বললে সম্মতির মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তির সাথে শারীরিক সম্পর্ক করা যাবে। আর এখানেই বাধে আরেকটি বিপত্তি। সম্মতি থাকলে যদি শারীরিক সম্পর্ক করা অপরাধ না হয় তাহলে একটি শিশু (১৮ বছর বয়সের নিচে) যদি শারীরিক সম্পর্কের জন্য সম্মতি প্রদান করে? অদ্ভুত হলেও সত্য পাশ্চাত্যের শিশুকামি ও সমকামীরা এই প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই করে আসছে।

পাশ্চাত্যে শিশুকামিতাকে অপরাধের চোখে দেখা হয় এবং এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো শিশুরা সম্মতি দিতে পারে না, তাদের সম্মতি প্রদানের মতো পর্যাপ্ত বয়স হয়নি। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ৮ বছর বয়সী ল্যাকটেশিয়ার আগমন ঘটে। ল্যাকটেশিয়া বাই ন্যাচার একটি সুস্থ-স্বাভাবিক ছেলে হলেও নিজেকে মনে মনে মেয়ে মনে করে, এককথায় সে ট্রান্সজেন্ডার।[7]Lactatia: The world’s youngest drag queen. (2017, June 16). NZ Herald. Retrieved January 13, 2024 শুধু ল্যাকটেশিয়া না বরং এরকম অনেক শিশুরা আছে যারা তাদের জেন্ডার নিয়ে কনফিউসড কিংবা তারা নিজেদের বিপরীত লিঙ্গের মনে করে।[8]Bagot, M. (2017, October 22). Record 50 kids a week sent to sex change clinics – and some are as young as four. The Mirror.

শিশুদের ভিতর ছড়িয়ে পরা এই যৌন উন্মাদনা প্যাডোফাইলদের নতুন যুক্তি প্রদান করে। একটি শিশু যদি নিজের লিঙ্গ বদলে ফেলার সম্মতি দিতে পারে তাহলে কি সে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি দিতে পারেনা! ইতিমধ্যে প্যাডোফাইলরা এই যুক্তি দেওয়া শুরু করেছে। হার্ম প্রিন্সিপালের আলোকে সত্যিই তাদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তারা প্যাডোফিলিয়াকেও বৈধতা দিবে যেভাবে সমকামীতাকে দিয়েছে। এখানেও হার্ম প্রিন্সিপাল সমাধান দিতে অপারগ। তার নিজের নীতিতে সে নিজেই ফেসে যাচ্ছে।

হার্ম প্রিন্সিপাল নীতিতে একটি রাষ্ট্র আদো স্থিতিশীল থাকবে কিনা তাও চিন্তার বিষয়। ব্যক্তি স্বাধীনিতাকে সর্বোচ্চ মনে করা জাতি নিশ্চয়ই এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ করার চেষ্টা করবেই। আর এই স্বাধীনতা হলো যা করতে করতে পারার স্বাধীনতা। সে অন্যের ক্ষতি না করে যা খুশি করতে পারবে। সে চাইলেই সম্মতি নিয়ে যেকোনো কারও সাথে শুতে পারবে, চাইলেই নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করতে পারবে। এমনকি ব্যক্তি চাইলেই আত্মহত্যা করতে পারবে এবং সে যদি তাকে হত্যা করার সম্মতিও দেয় তাহলে তাকে হত্যাও করা যাবে।

একটি রাষ্ট্রে সম্মতির ভিত্তিতে হত্যা, আত্মহত্যা ইত্যাদি বিপর্যয় রাষ্ট্রকাঠামো দুর্বল করে দেয়। আর যখন এই বিপর্যয়গুলো ম্যা পিপলের মাঝে ছড়িয়ে যায় তখন রাষ্ট্রের পতন অনিবার্য হয়ে পরে। আমেরিকা সেক্যুলার বিশ্বের মোড়ল হলেও উক্ত প্রাসঙ্গিক কারণেই সেখানে আত্মহত্যা অবৈধ। হার্ম প্রিন্সিপালকে সুপ্রিম মনে করা আমেরিকায় আত্মহত্যা অবৈধ হওয়া নিশ্চয়ই হার্ম প্রিন্সিপালের নীতির বিরোধী। তবে পাশ্চাত্যের অনেক দেশেই ব্যক্তি স্বাধীনতার খাতিরে হার্ম প্রিন্সিপালের অনেক নীতিই যথাযথ পালন করা হয়।

নেদারল্যান্ড ২০০২ সালে রোগীকে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে হত্যা করার জন্য ইউথেনেশিয়া নিয়ে আসে। আইনগতভাবে আত্মহত্যা জাস্টিফিকেশনের ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ড প্রথম দেশ। তাদের দাবি তারা রোগীকে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে তার সম্মতিক্রমে ইউথেনেশিয়া প্রদান করে কিন্তু এখানেই তাদের কারসাজি। ক্যাপিটালিজমের পূজা করা ক্ষমতাসীনরা কখনো বলে না রোগীর ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন কোনটি। মূলত একজন মানসিক বিকারগ্রস্থ কিংবা মানসিকভাবে অসুস্থ লোককেও তারা ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের রোগী হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে এর থেকেও জঘন্য ব্যাপার হলো পশুকামিতাকে বৈধকরণ।সমগ্র পাশ্চাত্য সভ্যতা টিকে আছে হিউম্যানিজম মতবাদের উপর। তাই পাশ্চাত্যের ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা কিংবা যা খুশি করতে পারার স্বাধীনতা ইত্যাদি মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে উক্ত নিয়ম-নীতি বাধ্যবাধকতা নেই।একজন মানুষ অন্য আরেকজন মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইলে সম্মতির প্রয়োজন।কিন্তু একটি অবলা পশুর ক্ষেত্রে সম্মতির কোন প্রয়োজন নেই। কাজেই ব্যক্তি তার ইচ্ছানুযায়ী একটি পশুর সাথে যেকোনো কিছু করতে পারে। জার্মানি ১৯৬৯ সালে পশুকামিতাকে বৈধতা প্রদান করে। যদিও আইন প্রণেতাদের শর্ত হলো প্রানীর সাথে যৌনকার্য চলাকালীন কোন সহিংসতা করা যাবেনা। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা জার্মান আইন প্রণেতাদের বাধ্য করে পশুকামকে অবৈধ ঘোষণা করার ব্যাপারে চিন্তা করতে।[9]Animal welfare: Germany moves to ban bestiality, bbc news

হার্ম প্রিন্সিপালকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বেশ চমকপ্রদ মনে হতে পারে। আর আমেরিকা যেভাবে এর প্রমোট করেছে তাতে আমেরিকাকে সুপ্রিম মনে করা লোকদের নিকট হার্ম প্রিন্সিপালকেও সুপ্রিম মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে হার্ম প্রিন্সিপাল একটি সমাজের জন্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের চেয়ে কম না। প্রতিটি মতবাদই তার অনুসারীদের ব্রেইনওয়াশ করে, পূর্বের ভ্যালুজ ধুয়ে-মুছে নিজের ভ্যালুজ পুশ করে। হার্ম প্রিন্সিপালও এর ব্যতিক্রম না। তবে এর ফলে তৈরি হওয়া সামাজিক বিপর্যয়কে মানুষ বুঝতে পারেনা। তাদের দৃষ্টিতে সর্বদাই এই গণবিধ্বংসী মতবাদগুলো শ্রেষ্ঠ যদিও সমাজ তখন পতনমুখী। একপর্যায়ে যখন মানুষ এর ভয়াবহতা বুঝতে পারে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।

হার্ম প্রিন্সিপালের আরেকটি সমালোচনা ব্যক্তি স্বাধীনতা কেন্দ্রিক হতে পারে। যেহেতু মানুষ কারও ক্ষতি না করে যা ইচ্ছে করতে পারে সেহেতু সে হেলমেট পরে বাইক চালাবে কি চালাবে না এতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার কথা ছিলোনা। কিন্তু রাষ্ট্র এখানে হস্তক্ষেপ করে। আমেরিকা এ ক্ষেত্রে ভিক্টিমলেস ক্রাইম বা ব্যক্তির ক্ষতিহীন অপরাধের কনসেপ্ট নিয়ে আসে। তবে হার্ম প্রিন্সিপালের মতো ভিক্টিমলেস ক্রাইম নির্ধারণের নির্ধারিত কোন মূলনীতি নেই। রাষ্ট্র যাকে ভিক্টিমলেস ক্রাইম বলবে তাই ভিক্টিমলেস ক্রাইম।

সেক্যুলারদের একটি কমন বৈশিষ্ট্য হলো এরা ধার্মিকদের স্পেশালি ধর্মান্ধ বলে কটাক্ষ করে। মুসলিমরা কোন প্রশ্ন ছাড়াই স্রষ্টার বিধান মেনে চলে এটাকে তারা ধর্মান্ধতা মনে করে। কিন্তু এই একই সেক্যুলাররা রাষ্ট্রের বেধে দেওয়া ভিক্টিমলেস ক্রাইমগুলোকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়। তারা তখন এক মুহুর্তও চিন্তা করেনা যে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে তারা অন্ধভাবে নিচ্ছে। এর অবশ্য কারণও আছে। সেক্যুলারিজম তাদের দিয়েছে সেক্সুয়াল ফ্রিডম আর এই ফ্রিডমে বুদ হয়েই তারা চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

হার্ম প্রিন্সিপালের ক্রিটিক নিয়ে বই লিখলেও সব কথা লেখা সম্ভব না। সেক্যুলারিজমের আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বে নৈতিকতার পতন অনন্য মাত্রা লাভ করেছে, আরও করবে। ইতিমধ্যে কোন কারণ ছাড়াই প্রাণীদের উপর অত্যাচার করে আনন্দ লাভ করা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্লেজার কনজিউম করা প্রজন্ম পাশ্চাত্যে অনেক আগেই জন্মলাভ করেছে. ৩য় বিশ্বের দেশগুলোতে বিদ্যমান ধর্মীয় বিশেষ করে ইসলামিক নীতি-নৈতিকতা ও সোসিয়াল নর্মসের কারণে এখন পর্যন্ত পাশ্চাত্যের মতো উক্ত অঞ্চল ভেঙে পরেনি। তবে পাশ্চাত্যের গণবিধ্বংসী মতবাদগুলো আমদানি শুরু হয়ে গিয়েছে। সেক্যুলার নীতিতে চলা ৩য় বিশ্বের দেশগুলোতে বিপদ সংকেত অনেক আগেই বাজতে শুরু করেছে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে পাশ্চাত্যের মতোই এই সমাজ অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। আর এই অন্ধকারের ভুক্তভোগী হবে আমি, আপনি, সবাই।

    Footnotes

    Footnotes
    1Spice: The History of a Temptation. (n.d.). Goodreads. https://www.goodreads.com/en/book/show/210364
    2Cavanaugh, W. T. (2009, November 1). The Myth of Religious Violence. https://doi.org/10.1093/acprof:oso/9780195385045.001.0001
    3The Encyclopedia of Libertarianism. (2023, December 23). SAGE Publications Ltd. https://uk.sagepub.com/en-gb/eur/the-encyclopedia-of-libertarianism/book232698
    4Pew Research Center. (2023b, April 26). What the data says about gun deaths in the U.S. | Pew Research Center.
    5Ulmanu, J. W. C. S. R. L. C. L. T. J. M. M. (2023, April 3). There have been 394 school shootings since Columbine. Washington Post.
    61 killed, 5 injured by Iowa school shooter on the first day after winter break. (2024, January 5). NBC News.
    7Lactatia: The world’s youngest drag queen. (2017, June 16). NZ Herald. Retrieved January 13, 2024
    8Bagot, M. (2017, October 22). Record 50 kids a week sent to sex change clinics – and some are as young as four. The Mirror.
    9Animal welfare: Germany moves to ban bestiality, bbc news
    Show More
    Back to top button