হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

হিন্দুধর্মে যক্ষ্মারোগের কারণ

হিন্দুধর্মগ্রন্থ অনুসারে যক্ষ্মারোগ হয় অতিরিক্ত যৌনসহবাসের ফলে। যে দিন-রাত-সন্ধ্যায় স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গমে মেতে থাকে তারই যক্ষ্মা রোগ হয়। আবার কাশি-শ্বাসকষ্টের রোগী যদি এই কাজে যুক্ত হয়, সেও যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়। এর উল্লেখ পাবেন আপনি কালিকা পুরাণে,[1]কালিকাপুরাণম্, অধ্যায় ২১, শ্লোক ৪৯-৫০, পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত, নবভারত পাব্লিশার্স, প্রথম সংস্করণ-১৯৫৯, পৃ-১৬৬

হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

যে ব্যক্তি, দিবা রাত্রি, সন্ধ্যা–সকল সময়েই রমণীতে আসক্ত হইয়া সুরতসেবা করে, হে রাজযক্ষ্মন্! তুমি তাহার শরীরে বাস করিবে ॥৪৯॥

যে ব্যক্তি, প্রতিশ্যায় রোগ, শ্বাসরোগ, কাসরোগ বা শ্লেষ্মরোগযুক্ত হইয়া মৈথুনাসক্ত হয়, তুমি, তাহাতে প্রবেশ করিবে ॥ ৫০॥

অক্ষয় লাইব্রেরীর অনুবাদে কাব্যানুবাদক একটু বিস্তৃত করেই হিন্দুদের জ্ঞান তুলে ধরেছেন,[2]বৃহৎ কালিকা পুরাণ, অধ্যায় ২৩, শ্রীআনন্দময় বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংশোধিত ও সম্পাদিত, অক্ষয় লাইব্রেরি – কলকাতা, পৃ ৫১-৫২

হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

দিবা কিম্বা সন্ধ্যা কালে নারী সহবাস। যেই করে পুরাইতে নিজ কাম আশ ॥

রুগ্ন দেহ হয়ে যেই মৈথুনেতে রত। নিত্যকাল পত্নী সনে থাকে বিরাজিত ॥

শয্যাত্যাগ সময়েতে হয়ে কামাতুর। রমণী সম্ভোগ করে যে জন প্রচুর ॥

ঋতু দিনে যেই করে রমণী সম্ভোগ। তাহারে ধরিবে তুমি রাজ যক্ষ্মারোগ ॥

তার দেহ হতে তোমা ছাড়িতে না হবে। চিরকাল আধিপত্য তোমার রহিবে ॥

যত চেষ্টা সেই জন করুক উপায়। তোমারে ছাড়িয়া সেই যাইবে কোথায় ॥

শিবের সাক্ষাৎ হলে তবু তার দেহ। রোগ মুক্ত হইবার পক্ষেতে সন্দেহ ॥

শিবের সাক্ষাৎ পেলেও যক্ষ্মা সারবে কিনা বলা যায় না, ভাবা যায়? না এই কাহিনি শুধুমাত্র কালিকা পুরাণেই সীমাবদ্ধ নয়। মহাভারতেও এর প্রয়োগ দেখা যায়। সেটা আমরা দেখবো একটু পর।

মূল কাহিনি

হিন্দুধর্মগ্রন্থে এই ঘটনাটি প্রচলিতঃ

চন্দ্রদেবতা সোমের ২৭জন স্ত্রী ছিল, কিন্তু সে তাদের মধ্যে শুধুমাত্র একজনকে নিয়েই পড়ে থাকতো। এতে বাকি স্ত্রীরা তাদের নিজেদের বাবার কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিযোগ করে। তাদের বাবারা সোমের এই কাজের জন্য এতটাই রাগান্বিত হয়েছিলেন যে তারা চন্দ্রকে যক্ষ্মা রোগের অভিশাপ দিয়েছিলো। সোম তখন তাকে বাঁচানোর জন্য ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করতে গিয়েছিলো, যিনি তাকে উত্সাহিত করতে পেরেছিলেন। এটি করার জন্য, ভগবান শিবের নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিরতির প্রয়োজন ছিল, যেটা নিয়ে আরেক মিথোলজি তৈরি হয়েছে, চাঁদের অমাবস্যা-পূর্ণিমাকে ঘিরে।

বিচিত্রবীর্য্যের মৃত্যু

এর উল্লেখ আছে মহাভারতের আদিপর্বে,[3]মহাভারত, আদিপর্ব ১০২/৭৭, অনুবাদঃ কালীপ্রসন্ন সিংহ

হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

এখানে বিচিত্রবীর্য্যের সাথে দুই বোনের একসাথে বিয়ে হয়, তারা হলেন অম্বিকা ও অম্বালিকা। তাদের কামে পড়ে রাজা বিচিত্রবীর্য্য টানা ৭ বছর ক্রমাগত স্ত্রী দু’জনের সাথে সেক্স করে গিয়েছেন। এবং এই কারণে তার যক্ষ্মারোগ হয়, আর চলে যান আকাশে বাতাসে।

ব্যুষিতাশ্বের মৃত্যু

এই ঘটনারও উল্লেখ আছে মহাভারতেই,[4]মহাভারত, আদিপর্ব ১২১/১৮, অনুবাদঃ কালীপ্রসন্ন সিংহ

হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

রাজা ব্যুষিতাশ্বের বিয়ের পর তিনি রাণী ভদ্রার রূপের কামে পড়ে যান। অল্পদিন পড় থেকেই রাজকাজ বাদ দিয়ে অন্দরমহলে দিন-রাত শুধু স্ত্রীর সাথে সেক্স করে বেড়াতেন। এবং এই কারণেই তার যক্ষ্মারোগ হয়। এবং মারা যান!

রাজা ব্যুষিতাশ্ব ও তার স্ত্রীর বাকি ঘটনা জানতে এই পোস্টটি পড়ুনঃ

রাজযক্ষ্মা সারানোর বৈদিক তন্ত্র-মন্ত্র

এর উল্লেখ আছে অথর্ববেদে,[5]অথর্ববেদ, কাণ্ড ৭, অনুবাদ ৭, সুক্ত ১-২, অনুবাদঃ বিজনবিহারী গোস্বামী

হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

বেদেও স্বীকার করা হলো যে এই রোগ নিরন্তর স্ত্রী সহবাসের ফলে হয়। আর এই রোগের নিরাময়ের জন্য এই মন্ত্রগুলো ব্যবহার করে দেবতার পূজা করতে হবে।

যক্ষ্মারোগীর বংশের মেয়ে বিয়ে করা যাবে না

এর উল্লেখ আছে মনুসংহিতা অধ্যায় ৩ এর মধ্যে,

হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

হীনক্রিয়, পুরুষসন্তানহীন, বেদাধ্যয়নরহিত, বহু লোমযুক্ত, অর্শ, যক্ষ্মা, মন্দাগ্নি, অপম্পার, শ্বিত্র বা কুষ্ঠরোগ গ্রস্ত ব্যক্তিদের বংশও (বর্জন করবে)।[6]মনুসংহিতা ৩/৭, অনুবাদঃ সুরেশচন্দ্র

কতটা মূর্খ হলে এই বিধান কেউ দিতে পারে!

রাজযক্ষ্মা কী?

এতোক্ষণ ধরে তো যক্ষ্মা-রাজযক্ষ্মা নিয়ে কথা বললাম। কিন্তু রাজযক্ষ্মা জিনিসটা আসলে কী?

রাজযক্ষ্মা আর যক্ষ্মারোগ মূলত একই রোগ। যক্ষ্মারোগেরই আরেক নাম। পূর্বে রাজাদের মধ্যে এই রোগ হয়েছিলো দেখে এর নাম রাজযক্ষ্মাঃ[7]গরুড়পুরাণ, পূর্বখণ্ড, অধ্যায় ১৫২, শ্লোক ১-৩, অনুবাদঃ চন্দ্রকুমার তর্কালঙ্কার, সংগ্রহঃ রসিকমোহন চট্টপাধ্যায়

হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

আয়ুর্বেদেও যক্ষ্মা আর রাজ-যক্ষ্মাকে একই জিনিস বিবেচনা করে চিকিৎসার কথা পাওয়া যায়।[8]https://archive.org/details/dli.bengal.10689.18009/page/n33/mode/1up

কিংবা, রাজযক্ষ্মা হলো যক্ষ্মার রাজা বা, যক্ষ্মারোগের সবচেয়ে মারাত্মক প্রকার।[9]https://bn.m.wikisource.org/wiki/পাতা:বিশ্বকোষ_ষোড়শ_খণ্ড.djvu/৩৭৬

রাজযক্ষ্মা আর টিউবারকিউলোসিস কি আলাদা?

অ্যাপোলোজিস্টদের দাবি হলো রাজযক্ষ্মা আর বর্তমানে বলা Tuberculosis (T.B) রোগ হলো আলাদা।

কিন্তু আমরা এটা আলাদা হওয়ার কোনো প্রমাণ পাইনি বরং এটা হিন্দুদের সবাই জানে যে এই টিউবারকুলোসিস রোগই আগে রাজরোগ/রোগরাজ/রাজযক্ষ্মা বলে প্রচলিত ছিলো।[10]Z. (2022, October 28). Tuberculosis: টিউবারকিউলোসিস সম্পর্কে যা জানা আপনার প্রয়োজন. . . Zee24Ghanta.com. Retrieved December 18, 2022, from https://zeenews.india.com/bengali/health/to-know-about-tuberculosis-what-to-do-and-what-not-to_447816.html চিত্তসুখ সান্যাল ও গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও রাজযক্ষ্মাকে টিউবারকুলোসিসই বলেছেন,[11]https://bn.m.wikisource.org/wiki/পাতা:সাহিত্য_পরিষৎ_পত্রিকা_(ষোড়শ_ভাগ).pdf/১৭০

হিন্দুধর্ম ও যক্ষ্মারোগ

আমাদের অবস্থান

যক্ষ্মারোগ যৌনতার কারণে হয় না, এবং যৌনতার কারণে ছড়ায় না।[12]Can TB be spread through kissing or having sex? – englanti. (n.d.). Retrieved December 10, 2022, from https://tuberkuloosi.fi/en/faqs/can-tb-be-spread-through-kissing-or-having-sex/ কাশি কিংবা শ্বাসকষ্টের রোগীও যৌনসহবাস করলে এই রোগ হয় না।

যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এই কথার ভিত্তি নাই।

বর্তমান চিকিৎসাতেই যক্ষ্মা ভালো হয়[13]D. (2022, March 25). যক্ষ্মা থেকে রক্ষা আছে. Daktarbhai. Retrieved December 10, 2022, from https://daktarbhai.com/blog/328/যক্ষ্মা-থেকে-রক্ষা-আছে, শিবের দর্শন পাওয়ার কী দরকার!

খুব সম্ভবত হিন্দুধর্মের বইগুলোতে এই রোগের ব্যাপারে কাহিনিগুলো যে লিখেছে, সে সম্ভবত কোনো ব্রাহ্মণকে অতিরিক্ত যৌনসহবাসের ফলে যক্ষ্মারোগে (কাকতালীয়) আক্রান্ত হয়ে মরতে দেখেছে। ব্রাহ্মণদের তো যৌনসঙ্গীর অভাব নেই, দেবদাসী থেকে শুদ্রা। বিস্তারিতঃ

অ্যাপোলোজিস্টিক ক্লেইম

অ্যাপোলোজিস্টদের দাবি হলো অতিরিক্ত সহবাসে বীর্য ক্ষয় হয়, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, ফলে যক্ষ্মারোগ বাসা বাধে।

– মূলত এই দাবিটি একটু দুর্বল কারণ, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া এবং রোগে আক্রান্ত হওয়া ভিন্ন জিনিস। রোগ যে হবেই তা নিশ্চিত নয়। আর যক্ষ্মারোগই হবে তাও নিশ্চিত নয়। কিন্তু কালিকাপুরাণে সাধারণভাবেই যক্ষ্মাকে আদেশ করা হয়েছে, তার মানে আবশ্যকভাবেই যক্ষ্মা আক্রান্ত হবে।

Footnotes

Footnotes
1 কালিকাপুরাণম্, অধ্যায় ২১, শ্লোক ৪৯-৫০, পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত, নবভারত পাব্লিশার্স, প্রথম সংস্করণ-১৯৫৯, পৃ-১৬৬
2 বৃহৎ কালিকা পুরাণ, অধ্যায় ২৩, শ্রীআনন্দময় বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংশোধিত ও সম্পাদিত, অক্ষয় লাইব্রেরি – কলকাতা, পৃ ৫১-৫২
3 মহাভারত, আদিপর্ব ১০২/৭৭, অনুবাদঃ কালীপ্রসন্ন সিংহ
4 মহাভারত, আদিপর্ব ১২১/১৮, অনুবাদঃ কালীপ্রসন্ন সিংহ
5 অথর্ববেদ, কাণ্ড ৭, অনুবাদ ৭, সুক্ত ১-২, অনুবাদঃ বিজনবিহারী গোস্বামী
6 মনুসংহিতা ৩/৭, অনুবাদঃ সুরেশচন্দ্র
7 গরুড়পুরাণ, পূর্বখণ্ড, অধ্যায় ১৫২, শ্লোক ১-৩, অনুবাদঃ চন্দ্রকুমার তর্কালঙ্কার, সংগ্রহঃ রসিকমোহন চট্টপাধ্যায়
8 https://archive.org/details/dli.bengal.10689.18009/page/n33/mode/1up
9 https://bn.m.wikisource.org/wiki/পাতা:বিশ্বকোষ_ষোড়শ_খণ্ড.djvu/৩৭৬
10 Z. (2022, October 28). Tuberculosis: টিউবারকিউলোসিস সম্পর্কে যা জানা আপনার প্রয়োজন. . . Zee24Ghanta.com. Retrieved December 18, 2022, from https://zeenews.india.com/bengali/health/to-know-about-tuberculosis-what-to-do-and-what-not-to_447816.html
11 https://bn.m.wikisource.org/wiki/পাতা:সাহিত্য_পরিষৎ_পত্রিকা_(ষোড়শ_ভাগ).pdf/১৭০
12 Can TB be spread through kissing or having sex? – englanti. (n.d.). Retrieved December 10, 2022, from https://tuberkuloosi.fi/en/faqs/can-tb-be-spread-through-kissing-or-having-sex/
13 D. (2022, March 25). যক্ষ্মা থেকে রক্ষা আছে. Daktarbhai. Retrieved December 10, 2022, from https://daktarbhai.com/blog/328/যক্ষ্মা-থেকে-রক্ষা-আছে
Exit mobile version