তাওবা নিয়ে দু’টি প্রচলিত ভুল ধারণা

তাওবা নিয়ে ভুল ধারণা ও জবাব।

আল্লাহ তা’আলা কি শিরক ক্ষমা করেন না?

এসম্পর্কে যে দলিলটি উল্লেখ করা হয়ঃ

“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করবেন না। এটা ছাড়া অন্য সব যাকে ইচ্ছে মাফ করবেন এবং যে আল্লাহর সাথে শরীক করল, সে এক মহা অপবাদ আরোপ করল।”[1]কুরআন, সূরা আন নিসা ৪:৪৮

উল্লেখ্য এই আয়াতটি আমরা বুঝতে ভুল করি। বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়েও আমাদের ভুলভাবে শেখানো হচ্ছে।

এর মানে হচ্ছে “(তাওবা ছাড়া)” কাওকে শিরক ক্ষমা করা হয় না। বাকি পাপগুলো আল্লাহ তাঁর ইচ্ছে হলে এমনিতেই অনেকসময় ক্ষমা করে দেন। এখানে সেটিই এসেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম দয়ালু।

যেমনঃ
আবূ হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, ‘এক ব্যভিচারিণীকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। সে একটি কুকুরের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন সে দেখতে পেল কুকুরটি একটি কূপের পাশে বসে হাঁপাচ্ছে। রাবী বলেন, পানির পিপাসা তাকে মুমূর্ষ করে দিয়েছিল। তখন সেই নারী তার মোজা খুলে উড়নার সাথে বাঁধল। অতঃপর সে কূপ হতে পানি তুলল (এবং কুকুরটিকে পানি পান করালো) এ কারণে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হল।’[2]সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৩২১

তাওবা করলে শিরকও ক্ষমা হয়।

“তিনি তওবাকারীর ও তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারীর সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।”[3]সূরা যুমার:৫৩

শির্ক ক্ষমা না করে কি সকল গুনাহ ক্ষমা করা যায়? তাছাড়াও বিশেষভাবে শির্ক থেকে তওবা করা ও সে তওবা কবুল হওয়ার প্রসঙ্গে এসেছে, আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:

“এবং তারা আল্লাহ্‌র সাথে কোন উপাস্যকে ডাকে না। আর আল্লাহ্‌ যাকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর তারা ব্যভিচার করে না; যে ব্যক্তি এগুলো করবে, সে শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বর্ধিতভাবে প্রদান করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়। তবে যে তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, ফলে আল্লাহ্‌ তার গুনাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[4]সূরা ফুরকান, আয়াত: ৬৮-৭০

দেখুন, এখানে কিন্তু প্রথমেই শিরকের ব্যাপারটি আনা হলো, এরপরেই তাওবা করার আহবান জানানো হলো।

আল্লাহ্‌ তাআলা খ্রিস্টানদের শির্ক ও কুফরের কথা উল্লেখ করার পর তাদেরকে তওবা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন:

“তারা অবশ্যই কুফরী করেছে যারা বলে, ‘আল্লাহ্‌ তো তিনের মধ্যে তৃতীয়। অথচ এক ইলাহ্‌ ছাড়া আর কোন ইলাহ্‌ নেই। আর তারা যা বলে তা থেকে বিরত না হলে তাদের মধ্যে যারা কুফরীর উপর অটল থাকবে তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে। তবে কি তারা আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে আসবে না ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আল্লাহ্‌ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[5]সূরা মায়িদা, আয়াত: ৭৩-৭৪

কী বুঝলেন?

নবী ﷺ আমর বিন আস (রাঃ) কে বলেছিলেন:
“হে আমর! তুমি কি জান না যে, ইসলাম পূর্বের সকল গুনাহ্‌ মাফ করে দেয়।”[6]সহিহ মুসলিম (১২১) ও মুসনাদে আহমাদ (১৭৮৬১).

আচ্ছা দেখুন, যে অমুসলিম, ধরুন প্রচলিত হিন্দু, সে কিন্তু শিরক করছে, সে যখনই আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, তার গুনাহগুলো কিন্তু মাফ করে দেওয়া হবে।
শিরক ক্ষমা না করে সকল গুনাহ কী মাফ হয়? সকল গুনাহের মধ্যে কি শিরক পড়ে না?

এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত পড়ুন এখানে।[7]https://islamqa.info/bn/answers/34171/ [8]https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=66&section=981

তাওবা সিস্টেম কি পাপকাজের অনুমতি দেয়?

“তাওবাহর লক্ষণ হলো অতীতের জন্য কাঁদা, গোনাহয় লিপ্ত হতে ভয় পাওয়া এবং খারাপ সাহচর্য ছেড়ে ভালোদের সাহচর্য বজায় রাখা। ” শাকিক আল-বালখি (রাহিমাহুল্লাহ) | আয-যাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৯/৩১৫

আল্লাহ কখনোই বলেন না পাপকাজ করতে। বলেন, পাপকাজ থেকে ফিরে এসো, আমি ক্ষমা করে দিবো। পাপকাজে যেয়ো না…

আমি যেহেতু ক্ষমাই পেয়ে যাবো, তাহলে পাপ করে নিজের প্রবৃত্তি সিদ্ধ করে নিই। পরে ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে।
—- এইরকমভাবে অনেকে বলার চেষ্টা করে তাওবা নাকি পাপ করার অনুমতি দেয়!

এটা নিঃসন্দেহে মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ আপনি আপনার তাক্বদীর জানেন না। আপনি জানেন না এই পোস্টটি পড়া পর্যন্ত আপনি বেঁচে থাকবেন কিনা। জানেন না, তাওবা করার সুযোগ হবে কিনা আপনার।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও গায়েব জানতেন না (তাঁকে যা জানানো হয়েছে তা ব্যতীত)।[9]সহিহুল বুখারী ৭৩৮০

তাই এইরকম সান্তনা আপনাকে শয়তান যোগায়। শয়তানের ফাঁদ, ইচ্ছেমতো পাপ করো, নারী ধর্ষণে লিপ্ত হও, পরে মাফ চেয়ে নিলেই হবে। কিন্তু এই ফাঁদ কখনোই বলবে না, আপনি তাওবা করার সুযোগ পাবেন কিনা। এবং আপনার তাওবা কবুল হবে কিনা।
সময় সুযোগ থাকতে এখুনি অনুতপ্ত হোন।

তাওবা করলেও দুনিয়ার শাস্তি মাফ হয় না (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)।
নিশ্চয়ই তাওবাকারী অসম্মানিত নন।

এই ঘটনাটি দেখুনঃ

ইমরান ইব্‌ন হুসায়ন (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেনঃ জুহায়না গোত্রের এক মহিলা রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এসে বললো যে, আমি যিনা করেছি আর সে গর্ভবতী ছিল। তিনি তাকে স্বীয় আত্মীয়-স্বজনের নিকট সোপর্দ করে দিলেন এবং বললেনঃ এর সাথে সদ্ব্যবহার কর, আর যখন সে প্রসব করবে, তখন তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। প্রসবের পর তাকে রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে নিয়ে আসা হলে তিনি তাকে পাথর মারার নির্দেশ দিলেন। তার উপর কাপড় জড়ানো হল, পরে পাথর মারা হল। অতঃপর তিনি তার জানাযার সালাত আদায় করলেন। উমর (রাঃ) বললেন, আপনি তার উপর জানাযার সালাত আদায় করলেন অথচ সে যিনা করেছে। তিনি বললেন, সে এমন তওবা করেছে যে, তা যদি সত্তরজন মদীনাবাসীকে বণ্টন করে দেওয়া হত তবে তা তাদের জন্য পর্যাপ্ত হয়ে যেত তুমি কি এরচেয়ে উত্তম তওবা দেখেছ, যে নিজকে আল্লাহ্‌ তা’আলার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছে?
[10]সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ১৯৫৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৯৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৪৪০; তিরমিযী, হাদীস ১৪৩৫; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৬০৩

একজন মুমিন পাপ করার সময় আর মুমিন থাকে না… তার মধ্যে তাকওয়া চলে যায়…
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ

যেনাকারী যখন যেনায় লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না। মদ্যপ যখন মদ পানে লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না। চোর যখন চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না। আর লুটতরাজ ও ছিনতাইকারী যখন লুটতরাজ ও ছিনতাই করে এবং লোকজন তার দিকে চোখ তুলে তাকায়, তখন সে মুমিন থাকে না।[11]সহীহুল বুখারী ২৪৭৫, ৫৫৭৮, ৬৭৭২, ৬৮১০, মুসলিম ৫৭, তিরমিযী ২৬২৫, নাসায়ী ৪৮৭০, ৪৮৭১, ৪৮৭২, ৫৬৫৯, ৫৬৬০, আবূ দাউদ ৪৬৮৯, আহমাদ ২৭৪১৯, ৮৬৭৮, ৮৭৮১, ৯৮৫৯, দারেমী ১৯৯৪, … See Full Note

অতএব কোনো মুমিন গুনাহ্ করতে পারে না।

আসুন আমরা গুনাহ্ ছেড়ে দেই, তাওবা করি। জানি না কাল বাঁচবো কিনা… সুযোগ আর হয়তো পাবেন না…

Footnotes

Footnotes
1 কুরআন, সূরা আন নিসা ৪:৪৮
2 সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৩২১
3 সূরা যুমার:৫৩
4 সূরা ফুরকান, আয়াত: ৬৮-৭০
5 সূরা মায়িদা, আয়াত: ৭৩-৭৪
6 সহিহ মুসলিম (১২১) ও মুসনাদে আহমাদ (১৭৮৬১).
7 https://islamqa.info/bn/answers/34171/
8 https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=66&section=981
9 সহিহুল বুখারী ৭৩৮০
10 সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ১৯৫৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৯৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৪৪০; তিরমিযী, হাদীস ১৪৩৫; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৬০৩
11 সহীহুল বুখারী ২৪৭৫, ৫৫৭৮, ৬৭৭২, ৬৮১০, মুসলিম ৫৭, তিরমিযী ২৬২৫, নাসায়ী ৪৮৭০, ৪৮৭১, ৪৮৭২, ৫৬৫৯, ৫৬৬০, আবূ দাউদ ৪৬৮৯, আহমাদ ২৭৪১৯, ৮৬৭৮, ৮৭৮১, ৯৮৫৯, দারেমী ১৯৯৪, ২১০৬, রাওদুন নাদীর ৭১৬, সহীহাহ ৩০০০, তাখরীজুল ঈমান লি ইবনু আবু শায়বাহ ৩৮-৪১, ইবনু মাজাহ ৩৯৩৬
Exit mobile version