মন্দির ধ্বংসের সাতকাহন – বানোয়াট বনাম প্রকৃত ইতিহাস

ভারতের মুসলমান সম্রাটদের “হাজার হাজার” মন্দির ধ্বংসের কথা বলা হয়ে থাকে প্রচলিত ইতিহাসে।
এক্ষেত্রে তারা সীতরাম গোয়েলের তথ্যকে তাদের মূল রেফারেন্স হিসেবে তুলে ধরে থাকে। গোয়েলের এই তথ্য প্রধানত ইলিয়ট ও ডওসন থেকে সংগৃহীত, যে গ্রন্থটির মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুসলিম শাসকদের বর্বর প্রমাণ করে ব্রিটিশ রাজত্বের গুনগান গাওয়া।

কিন্তু বিখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক রিচার্ড এম ইটনের গবেষণায় জানা যায়, পাঁচ শতাব্দীর বেশি সময়ে (১১৯২-১৭২৯) মোট আশিটি মন্দির মুসলিম সুলতানদের দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছে।[1]Temple Desecration and Muslim State in Medieval India, Richard M Eaton/ Lives Of Indian Images, Richard H Devis, p 66-69.

কিন্তু মুসলমানরা ভারতে আসার আগেও এই মন্দির ভাঙ্গাভাঙ্গী চলতো। কারা করতো? অবশ্যই তারা নিজেদের মধ্যে।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকার কলহনের বিখ্যাত ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে জানা যায়, একাদশ শতকে কাশ্মীরের হিন্দুরাজা হর্ষ (১০৮৯-১১০১) নিজের রাজকোষের বৃদ্ধির জন্য বহু হিন্দু মন্দির লুন্ঠন করেন । কলহন লিখেছেন, কোনো গ্রাম শহর বা নগরে এমন একটা মন্দির অবশিষ্ট ছিল না যার মূর্তি রাজা হর্ষের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি।

হর্ষের শাসনকালে ‘দেবোৎপাটননায়ক’ নামক একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল এই নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব পালন করার জন্য।[2]An Introduction to the Study of Indian History, DD Kosambi / ভারত ইতিহাস চর্চার ভূমিকা, কে পি বাগচি, পৃ ৩০৮

দ্বাদশ শতকে গুজরাটের পারমার হিন্দু রাজারাও যেমন সুভাত বর্মণ (১১৯৩-১২১১) সম্পদের লোভে দাভয় ও ক্যাম্বে অঞ্চলের বহু জৈন মন্দির লুন্ঠন করেন।[3]সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, জে পি বাগচি এন্ড কোম্পানি, পৃ ৪৭

আসলে রাজা এই মন্দিরগুলো ততকালীন সময়ে ধন-সম্পদের অকল্পনীয় ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছিল। চোল রাজ প্রথম রাজরাজ একাই সুবিশাল তাঞ্জোর মন্দিরে ৪১,৫৫৭ কলঞ্জু (প্রায় ৪৮৪ পাউন্ড) ওজনের স্বর্ণসামগ্রী, ১০,০০০ মণ মণিরত্ন, সম পরিমাণ সোনা ও ৫৭টি গ্রাম দান করেছিলেন।

সোমনাথের মন্দির ১০,০০০ গ্রামের রাজস্ব ভোগ করত। তেমনি নালন্দা ও বলভীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির প্রত্যেকে ২০০ গ্রাম থেকে রাজস্ব পেত।[4]আর্লি ইন্ডিয়া : এ কনসাইজ হিস্ট্রি, ডি এন ঝাঁ, পৃ ১৮০;  রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, পৃ ১৪৬

ফলে ধনসম্পদে পূর্ণ মন্দির ও ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলি ভারতীয় শাসক আর বিদেশি আক্রমণকারী উভয়কেই আকর্ষণ করেছিল।

কাশ্মীরের বেশ কয়েকজন রাজা দেবতার সম্পদ কেড়ে নিয়েছিলেন। শংকরবর্মণ (৮৮৩- ৯০২) ৬৪টি মন্দির লুট করেছিলেন। রাজা কলশ (১০৬৩-৮৯) সূর্যমূর্তি ধ্বংস করেন এবং বৌদ্ধ মঠ থেকে বহু মূর্তি নিয়ে চলে যান।[5]আর্লি ইন্ডিয়া : এ কনসাইজ হিস্ট্রি, ডি এন ঝাঁ, পৃ ১৮০-৮১

আদি ও মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে হিন্দু রাজাদের নিজেদের মধ্যকার লড়াইয়ের ফলে বেশকিছু মন্দির বিনষ্ট হওয়ার উদাহরণ পাওয়া যায়ঃ

  1. পল্লব রাজবংশের রাজা প্রথম নরসিংহবর্মন (৬৩০-৬৬৮) চালুক্যদের রাষ্ট্রদেবতা মন্দিরের মূল বিগ্রহ গণেশ মূর্তি ৬৪২ সালে লুন্ঠন করেন।
  2. চালুক্য রাজা ৬৯৩ সালে উত্তর ভারতে অভিযান চালিয়ে পরাজিত রাজাদের মন্দির থেকে গঙ্গা ও যমুনার দেবীমূর্তি লুন্ঠন করেন।
  3. অষ্টম শতকে কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্যের (৬৯৯-৭৩৬) রাজ্যে হানা দিয়ে পাল রাজারা কাশ্মীরে রাজাদের রাষ্ট্রদেবতা রামস্বামী নামক বিষ্ণু মূর্তিকে ভেঙে দেন।
  4. একাদশ শতকের প্রথম দিকে চোল রাজা প্রথম রাজেন্দ্র (১০১৪-১০৪২) বিভিন্ন রাজমন্দির থেকে বিভিন্ন দেবমূর্তি লুট করেন।
  5. ওড়িশার সূর্যবংশী গজপতি বংশের রাজা কপিলেন্দ্র ১৪৬০ সালে তামিল রাজাদের রাজত্বে যুদ্ধাভিযান চালিয়ে বহু শৈব ও বৈষ্ণব মন্দির বিধ্বস্ত করেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে মন্দির ধ্বংস বা লুণ্ঠনের পেছনে রাজাদের মূল কারণ ছিলো জাগতিক লোভ। আর ধনদৌলতের ভাণ্ডার রূপে মন্দির ছিল সামরিক অভিযানের সব থেকে আকর্ষণীয় লক্ষ্য।[6]আর্লি ইন্ডিয়া : এ কনসাইজ হিস্ট্রি, ডি এন ঝাঁ, পৃ ১৮১ এছাড়াও আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এনেছেন রিচার্ড ইটন সেটা হলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা, কোন হিন্দু যখন কোন হিন্দু রাজার এলাকার বা কুল দেবতার মন্দির ধ্বংস করতো এর অর্থ হলো সেখানে তার আধিপত্য কায়েম করা।

‘মোট কথা রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতার সাধারণ স্থান হিসাবে মন্দিরগুলি নির্ধারিত হত।’[7]Essays on Islam and Indian History, Richard M Eaton, p 107

রিচার্ড ইটন অসংখ্য শিলালিপি, ঘটনাপঞ্জি ও বিদেশি পর্যটকদের বিবরণী ইত্যাদি তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, মুঘল পিরিয়ডে সেইসব মন্দিরই ধ্বংস বা কলুষিত করা হয়েছে যেগুলির রাজনৈতিক সংযোগ ছিল অর্থাৎ যেগুলি কোনো শত্রু বা বিদ্রোহী রাজার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত।

এক্ষেত্রে রিচার্ড ইটনের মতামত হচ্ছে ঐ মন্দির ধ্বংসের কারণ ছিলো রাজনৈতিক বা আধিপত্য কায়েম করা, কোন ধর্মীয় কারণে না। নাহলে সমগ্র মুঘল পিরিয়ডে মাত্র ৮০ টা মন্দির কেন ধ্বংস করা হলো?

যাইহোক রোমিলা থাপার মনে করেন যে, প্রতিটি মন্দির ধ্বংস বা বিলুপ্ত হলে জনপ্রিয়ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, মুসলিম ধ্বংসকারীদের জন্য তা হয়েছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, রাজানুগত্যে বঞ্চিত হয়ে বহু মন্দির অবলুপ্ত হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শুধু বহু মন্দির নয়, বহু মসজিদও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।[8]রোমিলা থাপার, কমিউনালিজম অ্যান্ড হিস্টরিক্যাল লিগ্যাসি: সাম ফ্যাক্টস, সোস্যাল সায়েন্টিস্ট, জুন-জুলাই, ১৯৯০, পৃ. ১৩

তিনি দেখিয়েছেন, উনিশ শতকে বিশাখাপত্তনমের সিংহচলন মন্দিরটি ধ্বংস হয় রাজানুগত্যে বঞ্চিত হয়ে ও প্রাকৃতিক কারণে। অথচ এই মন্দির ধ্বংসের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়।[9]রোমিলা থাপার, কমিউনালিজম অ্যান্ড হিস্টরিক্যাল লিগ্যাসি: সাম ফ্যাক্টস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯

এমন দৃষ্টান্ত আরো রয়েছে।[10]আর এম ইটন, টেম্পল ডি-সিক্রেশান ইন প্রি-মডার্ন ইন্ডিয়া, ফ্রন্টলাইন, ২২ ডিসেম্বর ২০০০ ও ০৫ জানুয়ারি ২০০১

Footnotes

Footnotes
1 Temple Desecration and Muslim State in Medieval India, Richard M Eaton/ Lives Of Indian Images, Richard H Devis, p 66-69.
2 An Introduction to the Study of Indian History, DD Kosambi / ভারত ইতিহাস চর্চার ভূমিকা, কে পি বাগচি, পৃ ৩০৮
3 সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, জে পি বাগচি এন্ড কোম্পানি, পৃ ৪৭
4 আর্লি ইন্ডিয়া : এ কনসাইজ হিস্ট্রি, ডি এন ঝাঁ, পৃ ১৮০;  রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, পৃ ১৪৬
5 আর্লি ইন্ডিয়া : এ কনসাইজ হিস্ট্রি, ডি এন ঝাঁ, পৃ ১৮০-৮১
6 আর্লি ইন্ডিয়া : এ কনসাইজ হিস্ট্রি, ডি এন ঝাঁ, পৃ ১৮১
7 Essays on Islam and Indian History, Richard M Eaton, p 107
8 রোমিলা থাপার, কমিউনালিজম অ্যান্ড হিস্টরিক্যাল লিগ্যাসি: সাম ফ্যাক্টস, সোস্যাল সায়েন্টিস্ট, জুন-জুলাই, ১৯৯০, পৃ. ১৩
9 রোমিলা থাপার, কমিউনালিজম অ্যান্ড হিস্টরিক্যাল লিগ্যাসি: সাম ফ্যাক্টস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯
10 আর এম ইটন, টেম্পল ডি-সিক্রেশান ইন প্রি-মডার্ন ইন্ডিয়া, ফ্রন্টলাইন, ২২ ডিসেম্বর ২০০০ ও ০৫ জানুয়ারি ২০০১
Exit mobile version