কালচার বনাম আইডিয়োলজি, কার পাল্লা ভারী?

আধুনিক বিশ্বে নিজেদের কালচার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সচেতন কোন জাতি থাকলে সেটি হচ্ছে জাপানিজরা। প্রাত্যাহিক জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও জাপানিজরা কড়াভাবে তাদের কালচার মেনে চলে। সর্বদা বাড়িতে আসার পর অভিভাধন জানানো, খাওয়ার সময় কাঠির ব্যবহার, অসুস্থ হলে মাস্ক ব্যবহার ইত্যাদি জাপানিজদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরও ইস্টেরেস্টিং ব্যাপার হলো উৎসবের দিনগুলোতে তাদের ট্রেডিশনাল ড্রেসকোড মেইনটেইনের প্রতি মারাত্মক ঝোঁক। জাপানিজদের প্রধান উৎসবগুলোতে তারা পূর্বের ধারা বজায় রেখেই আতশবাজি ফাটিয়ে, কিমোনো পরে (ট্রেডিশনাল ড্রেস) উদ্‌যাপন করে। এসবের সাথে থাকে তরুণ-তরুণীদের পালকি বহন। মূলত সমগ্র উৎসবটাই পৌত্তলিকতা ঘিরে পালন হয়।

নিজেদের কালচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এনরিচড হওয়া সত্ত্বেও জাপানিজ জাতি উন্নতির মুখ দেখেনি। বরং ধীরে ধীরে সামাজিক অবক্ষয়, জনসংখ্যা হ্রাস, নৈতিকতার অবক্ষয়ের মতো সমস্যাবলি কারণে সাফার করছে। আধুনিক কালচারালিস্টদের ব্যাখ্যা অনু্যায়ী জাপানিজদে একটা হাইক্লাস জাতি হওয়ার কথা ছিল। যারা সুপার পাওয়ার হওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু জাপানিজদের ক্ষেত্রে এই সমীকরণ মিলে না। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের পর নানা কারণে জাপান বহির্বিশ্বের সাথে সামরিক পাল্লা দিয়ে মিলিটারি রাখতে পারেনি। এখনো জাপানে শুধুমাত্র নিজেদের দেশকে রক্ষার শর্তে নামেমাত্র সামরিক বাহিনী রয়েছে[1]Teslik, L. H. (2006, April 13). Japan and Its Military. Council on Foreign Relations. https://www.cfr.org/backgrounder/japan-and-its-military। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকার প্রভাবে জাপানিজ সামরিক বাহিনীর শক্তি খর্ব করতে কন্সটিটিউশন আইন প্রণয়ন হয়। যা ২০১৪ সালে দায়েশ কর্তৃক দুজন জাপানিজ নাগরিকদের হত্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বদলানো হয়। তবে মূল আইন একই রয়েছে যা জাপানকে যুদ্ধে জড়ানোর অনুমতি দেয়না কিন্তু সংশোধনের পর তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য জাপানিজ আর্মির ব্যবহারকে বৈধতা দেয়[2]Tokyo, K. S. (2014, July 1). Japan Ends Ban on Military Self-Defense. TIME. https://time.com/2946076/japan-ends-ban-on-military-self-defense/। ২০০০ সালে জাপানের মিনিস্ট্রি অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্স একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে যেখানে বেশ নির্লজ্জভাবে হিরোশিমা ও নাগাসাকি বোম্বিং এর বৈধতার জন্য যুক্তি দেওয়া হয়[3]MOFA: Remember why Hiroshima happened. (n.d.). https://www.mofa.go.jp/j_info/japan/opinion/paul.html। কালচারালিস্টদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী জাপান কিছুই পূরণ করতে পারেনি। সে না পেরেছে হাইক্লাস ভ্যালুয়েবল রাষ্ট্র হতে আর না পেরেছে নিজেদের আত্মপরিচয় ধারণ করতে।

জাপানের কালচারাল সমৃদ্ধি মূলত কালচারালের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন আইডিওলজি প্রতিষ্ঠা সম্ভব এই ধারণার বিপরীতে অবস্থান নেয়। এর বিপরীতে দেখা যায় নিছক কালচার কিংবা ট্রেডিশনের প্রসার না করে আইডিওলজি বাস্তবায়ন করে বর্তমানে আমেরিকা প্রভাব বিস্তার করছে। এমনকি খোদ জাপানিজদের একপক্ষই এখন আমেরিকার হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটমিক বম্ব ব্যবহারের বৈধতা দিতে ব্যস্ত। একইভাবে জাপানিজরা বিশ্বযুদ্ধ চলমান সময়কালে বিশ্বাস করতো জাপানিজ সম্রাট হিরোহিতোকে দেবতাদের বংশোদ্ভুত। কাজেই তার কথার অমান্য করা যাবেনা। এই বিশ্বাস থেকেই তারা মোরাল স্ট্যান্ডার্ড থেকে সম্রাটের কথা মেনে চলতো। অর্থাৎ একমাত্র বিশ্বাসের কারণেই জাপানিজরা নিজেদের আত্মপরিচয় বজায় রাখতে পেরেছিলো নিছক কালচারের মাধ্যমে না। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে সহজ হবে।

আজ থেকে প্রায় যুগ আগে বাঙালি মুসলিমদের মাঝে পহেলা বৈশাখ বেশ হাইপড ছিলো। বছরের অন্যান্য দিন কর্মব্যস্ত থাকা বাঙালি এই দিন উদ্‌যাপনে খুব সকালে চলে যেত রমনায়। বাঙালি মুসলিম এবং সেক্যুলার শাহবাগী উভয়ই এই দিনটিকে জোরেসোরে উদ্‌যাপন করতো। খোদ আমার পরিবারই এই দিনকে কেন্দ্র করে আমাকে ফতুয়া-পাঞ্জাবি কিনে দিতো। কিন্তু এখন আমার পরিবার এই দিনটির কথা মনেও করেনা। একইভাবে আমিও এই দিনটিকে ত্যাগ করেছি প্যাগানদের সাথে সম্পর্কের কারণে। আমার পরিবারের মতোই অসংখ্য বাঙালি ছিলো যারা এই দিনকে উপলক্ষ্য করে জামা-কাপড় কিনতো। তারাও বর্তমানে এই দিনকে মনে করার প্রয়োজন বলেও চিন্তা করেনা। বিপরীতে সেক্যুলার শাহবাগিরা ঠিকই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন করছে, প্রতি বছরই তারা প্যাগান রিচুয়ালস মেইনটেইন করে মঙ্গল শোভাযাত্রাও বের করছে। কারণ এটা তাদের আকিদার অংশ, তারা এই দিনকে উদ্‌যাপন করছে নিজেদের সেক্যুলার-কলকাতার মিশ্রিত আইডিওলজি থেকে। যদি পহেলা বৈশাখ পালনকারী মানুষের সংখ্যা আরও কমে যায় তারপরও তারা পালন করবেই।অন্যদিকে আমার পরিবারের মতো অন্যান্য বাঙালি মুসলিম পরিবারগুলো পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন করতো নিছক কালচার হিসেবে যা তৎকালীন সময়ে হাইপ্‌ড ছিলো। তাই নির্দিষ্ট সময় পর যখন এই উদ্‌যাপন তাদের আর আনন্দ দেয়নি কিংবা তারা এর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, অথবা তাদের আইডিওলজির (ইসলাম) সাথে ক্লাশ করায় তারা একে পরিত্যাগ করেছে।

আইডিওলজি হলো ওই বিশ্বাস সমূহ যা কালচারকে প্রভাবিত করে, পরিবর্তন করে[4]Routledge Revivals: Ideology and Cultural Production (1979). (n.d.). Routledge & CRC Press. https://www.routledge.com/Routledge-Revivals-Ideology-and-Cultural-Production-1979/Barrett-Corrigan-Kuhn-Wolff/p/book/9781138480360। একটি নির্দিষ্ট আইডিওলজির জনসাধারণ কখনো এমন কিছু মেনে নেয়না যা তাদের আইডিওলজির সাথে যায়না চাই তা যত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি হোক না কেন। মুসলিমদের ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে কন্ট্রাডিক্ট করায় তারা এমন অনেক কালচারই ত্যাগ করেছে যা একসময় এই অঞ্চলে বেশ পরিচিত ছিলো। বিপরীতে কালচার আদর্শ ছাড়া খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনা। টিকলেও তা মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনা, যেমনটা জাপানিজদের ক্ষেত্রে হয়েছে। একই ধারায় জুব্বা-পাঞ্জাবি, রং-বেরঙের বোরকা, বিভিন্ন উপলক্ষে মাজার, মসজিদ আলোকসজ্জা, বিভিন্ন বিষয় ও দিনকে উপলক্ষ বানিয়ে মিলাদ, ভাড়া করে কোরআন খতম, খাবারের আয়োজন, শবই বরাত, শবই মেরাজ, আশুরা, কিংবা ঈদ-ই-মিলাদুন্নবিকে কালচার হিসেবে ব্যবহার করে ইসলামের বিজয় সম্ভব নয়। এগুলোকে কালচারাল ওয়ারের টুল হিসেবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানুষ ব্যবহার করলেও একসময় তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আর এর স্থায়িত্বকাল গড়ে মাত্র এক প্রজন্ম পর্যন্ত। একটি প্রজন্ম পরেই কালচার জনগণের মাঝে আর প্রভাব বজায় রাখতে পারেনা। পাশাপাশি উক্ত দিনগুলো বর্তমানের রসম-রেওয়াজের মাধ্যমে উদ্‌যাপন ইসলামের মৌলিক ফাহম ধারণকারী প্রথম শ্রেষ্ঠ প্রজন্মদ্বয়ের মাঝে পাওয়া যায়না বলেও জনসাধারণ একে কালচার হিসেবে একসময় পরিত্যাগ করে[5]এখানে মূলত নিফসে মিন শাবান, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের মেরাজ গমন ইত্যাদিকে অস্বীকার করা হয়নি কিন্তু বর্তমানে এই দিনগুলো উৎযাপনে সালাফদের … See Full Note। মূলত এই কারণেই উক্ত বিষয়, উৎসব এবং দিনগুলোকে কালচারাল ওয়ারের নামকরণে পালন করলেও তা ইসলামের বিজয় এনে দিতে পারবে না, ইসলামের বিজয় আসবে শুধুমাত্র আদর্শিক অবস্থান থেকে। যেমনটা আমরা গত শতাব্দীর ইসলামিক আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে দেখেছি, এখনো দেখছি। ইসলাম তার আইডিওলজির গত চৌদ্দশত বছরেও পরিবর্তন করেন নি, নাহি আরো চৌদ্দশত বছর পার হলেও করবে, তবুও ইসলাম সবচেয়ে শক্ত ভাবে টিকে ছিল, ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।

Footnotes

Footnotes
1 Teslik, L. H. (2006, April 13). Japan and Its Military. Council on Foreign Relations. https://www.cfr.org/backgrounder/japan-and-its-military
2 Tokyo, K. S. (2014, July 1). Japan Ends Ban on Military Self-Defense. TIME. https://time.com/2946076/japan-ends-ban-on-military-self-defense/
3 MOFA: Remember why Hiroshima happened. (n.d.). https://www.mofa.go.jp/j_info/japan/opinion/paul.html
4 Routledge Revivals: Ideology and Cultural Production (1979). (n.d.). Routledge & CRC Press. https://www.routledge.com/Routledge-Revivals-Ideology-and-Cultural-Production-1979/Barrett-Corrigan-Kuhn-Wolff/p/book/9781138480360
5 এখানে মূলত নিফসে মিন শাবান, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের মেরাজ গমন ইত্যাদিকে অস্বীকার করা হয়নি কিন্তু বর্তমানে এই দিনগুলো উৎযাপনে সালাফদের বিপরীতে রসম-রেওয়াজ এবং সালাফদের বিপরীতে এই দিনকে কেন্দ্র করে ইবাদত গ্রহনের সমালোচনা করা হয়েছে
Exit mobile version