শয়তানের কনফারেন্স

শয়তানের কনফারেন্স
(কোন এক মহাসাগরের গভীরে নির্মিত এক সুরম্য প্রাসাদের অভ্যন্তরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে….)
বিশাল চারকোণা টেবিলের চতুর্দিকে উৎসুক মুখগুলো চেয়ে আছে টেবিলের অপর প্রান্তে। কালো আলখেল্লা পরে আসনে উপবিষ্ট হল শয়তান সর্দার। বাৎসরিক রিপোর্ট গ্রহণের দিন আজ….
বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরত ডেপুটি শয়তানরা তাদের রিপোর্ট পেশ করতে এসেছে। রিপোর্ট গ্রহণ শুরু হল।
শয়তান সর্দার: ডেপুটি ওয়াহদা, আপনার রিপোর্ট পেশ করুন।
ডেপুটি ওয়াহদা: মহামান্য শয়তান, আমার টিম গত এক বছরে ১৩ হাজার তরুণ তরুণীকে সালাহ হতে বিরত রেখেছে।
শয়তান সর্দার: মারহাবা! তোমরা কি কি কৌশল অবলম্বন করেছ?
ডেপুটি ওয়াহদা: আমাদের বেশ কিছু নতুন কৌশল সফল হয়েছে, আরো কিছু পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। আমরা প্রথম যে কৌশল অবলম্বন করেছি, তা হল, আধুনিকমনা তরুণদের নিকট, সালাহ, মেডিটেশন, যোগব্যায়াম প্রভৃতিকে সমতুল্য হিসেবে তুলে ধরেছি। এরপর সালাহর তুলনায় বাকি দুইটিকে চটকদার মোড়কে উপস্থাপন করেছি। ব্যাস!! আধুনিকমনা হতে গিয়ে….. (ক্রূর হাসি হাসল)…. হেহেহে! আর বুইড়াগুলারে বুঝিয়েছি, সালাহ পড়লে হার্টের অসুখ ভাল হয়, ব্লাড প্রেসার লো হয়, ফলে তারা সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করার পরিবর্তে হার্টের অসুখ ভাল হওয়ার জন্য সালাহ পড়েছে। এই বছর নতুন স্ট্রাটেজী ছিল এই দুইটি। আর পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আপাতত, আমিন আস্তে বলা, জোরে বলা, রাফাইদিন করা না করা নিয়ে গ্যাঞ্জাম লাগানোর চেষ্টায় আছি, এতে সাধারণ মুসল্লীরা মসজিদ বিমুখ হবে বলে আশা করছি। আর আগের “প্যান্ট নষ্ট” থিওরী এখনও চালু আছে।
শয়তান সর্দার: হুম, ভাল কাজ দেখিয়েছ। ডেপুটি ইছনানা, তোমার কি অবস্থা?
ডেপুটি ইছনানা: মহামান্য শয়তান, গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক ব্যভিচারের রেকর্ড গড়েছি আমরা।
শয়তান সর্দার: নতুন কোন কৌশল?
ডেপুটি ইছনানা: এই বছরে সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল ছিল, বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাধ্যতামূলকভাবে ছাত্র ছাত্রীদেরকে দুই মাসের জন্য স্টাডি ট্যুরের ব্যাবস্থা করা। যেখানে মূলত, নদীর চর, পাহাড়ী এলাকা, বনাঞ্চলে “প্রকৃতির সাথে একাত্মতা” ক্যাম্পেইনের নামে ক্যাম্পিং করানো। তরুণ প্রজন্ম হতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে!
শয়তান সর্দার: Excellent!!!! আর কেউ নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছ?
(ডেপুটি আরবাআ হাত তুলল)
শয়তান সর্দার: বল।
ডেপুটি আরবাআ: আমরা কিছু দাঁড়িওয়ালা রোমিও আর হিজাবী জুলিয়েট সৃষ্টি করে ইসলামের বাহ্যিকতার বিরুদ্ধে মানুষের অন্তরে ঘৃণার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি।
শয়তান সর্দার: Great! এই প্রকল্প নিয়ে আমরা অবশ্য অনেক আগে থেকেই কাজ করছিলাম…….(একটু থেমে), তা আমাদের নতুন ডেপুটি, ডেপুটি জাদীদ…. তার কি অবস্থা? আপনার রিপোর্ট কি?
(এক কোণায় নিভৃতচারে বসে থাকা ছোটখাট ডেপুটি জাদীদ কাঁচুমাচু হয়ে বলল…..)
ডেপুটি জাদীদ: আমার টিম যথাসাধ্য চেষ্টা করে এক তরুণকে বিপথগামী করেছে।
(পুরো কনফারেন্স রুমে হাসির হুল্লোড় উঠল…. ‘মাত্র একজনকে?’, ‘হাহাহ! এটা তো আমার বা হাতের কড়ে আঙুলের কাজ’, ‘এই রিপোর্ট নিয়ে কনফারেন্সে এসেছে! হাহ!’)
শয়তান সর্দার হাত তুলতেই গুঞ্জন থেমে গেল।
শয়তান সর্দার: বিস্তারিত বল, শুনি।
ডেপুটি জাদীদ: ছেলেটি ছিল সাধারণ আর দশটি তরুণের মতই। হঠাৎ সে তার বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ইসলামের আহবান পেয়ে বেশ জোরেশোরে ইসলামের কাজ করতে থাকে। আমরা বিভিন্ন সুন্দরী তরুণীর অফার নিয়ে, ভাল চাকরির অফার নিয়ে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনমতেই তাকে টলানো যাচ্ছিলনা। ফেইসবুকেও সে ছিল রীতিমত সেলেব্রেটি। তার পোস্টগুলোতে শত শত লাইক পড়ত। একদিন একটি হিজাবওয়ালা মেয়ে তাকে ইনবক্সে প্রশ্ন করে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে বিভক্তির কারণ জানতে চায়। সেও সোৎসাহে উত্তর দেয়। মেয়েটি সন্তুষ্ট হয়ে তার পরের সব পোস্টে লাইক দিতে থাকে। আমরাও পেয়ে গেলাম সুযোগ। তার অন্তরে এ ধারণা দিতে থাকলাম যে, মেয়েটি তাকে খুব পছন্দ করে। এরপর থেকে সে প্রতিদিন মেয়েটির লাইক পাওয়ার জন্যই পোস্ট দিতে থাকে। প্রতিটি নোটিফিকেশনে সে অধীর আগ্রহে মেয়েটির নাম খুঁজত। এরই মাঝে মেয়েটি ইনবক্সে আরও বেশ কিছু বিষয় জানতে চায়। সেও তা জানায়। হঠাৎ একদিন মেয়েটি জানায়, সে তাকে পছন্দ করে ফেলেছে, কিন্তু সে বিবাহিতা, সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে এবং সে চায় ছেলেটি যেন তাকে ব্লক করে দেয়। ছেলেটি ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবেই নেয়, তবে সে মেয়েটিকে ব্লক করেনা। পরে মেয়েটি নিজেই তাকে ব্লক করে দেয়। এরপর থেকেই আমাদের পরিকল্পনা শুরু। কিছুদিন পর ছেলেটি, মেয়েটির নাম লিখে সার্চ দেয়, কিন্তু পায়না। এরপর সে অন্য একটি একাউন্ট খুলে সার্চ দেয়, তাও পায়না। প্রতিদিন সে তাকে খুঁজে, কিন্ত পায়না। প্রতিটা নোটিফিকেশনে সে খুঁজে মেয়েটিকে, তার অন্তরে আশা, মেয়েটি হয়ত অন্য কোন নাম নিয়ে আসবে….. কিন্তু না, সে আর আসেনা…. এভাবে পোস্ট, শেয়ার লাইক এসব ছেলেটির কাছে উদ্দেশ্যহীন মনে হতে থাকে। আমরা তার অন্তরে প্ররোচনা দিলাম, তুমি তো মুনাফিকি করছ, ভাব দেখাচ্ছ ইসলামিক, অথচ পোস্ট দিচ্ছ একটা মেয়ের জন্য! সে লজ্জা পেতে থাকে, এই লজ্জা তাকে হতাশার দিকে নিয়ে যায়, আর এই হতাশার বৃত্ত তাকে তার স্রষ্টার প্রতি হতাশ করে দিয়েছে। সে লজ্জায় স্রষ্টার মুখোমুখি হয়না, সে ভাবছে সে শেষ হয়ে গেছে, সে ভাবছে আমি নিজেই যে লজ্জার কাজ করেছি, আবার কোন মুখে মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকব? আস্তে আস্তে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আর এখন সে, হতাশা আর যন্ত্রণায়, ড্রাগস নেয়া শুরু করেছে, বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছে…
শয়তান সর্দার: তুমি খুব সূক্ষ্ণ চাল চেলেছ। মূলত আজকের কনফারেন্সের সবচেয়ে সফল ব্যক্তি আসলে তুমিই। অন্যরা সবাই, কাউকে না কাউকে পাপী বানিয়েছে, কিন্তু এরা মাফ চাইলে, ফিরে আসলে আল্লাহ এদের সবাইকে মাফ করে দিবে। আর তুমি আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দাকেই গাফিল করেছ, আর আল্লাহর দিকে তার ফিরে আসার পথ চিরতরের জন্য বন্ধ করে দিয়েছ যা তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে…. মূলত এটাই আমাদের উদ্দেশ্য, এবং তুমি অত্যন্ত সফলতার সাথে তা করেছ। অন্য কেউই চূড়ান্তভাবে জাহান্নামে নেয়ার উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেনি, আর তাই এ বছরের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার তুমিই অর্জন করতে যাচ্ছ!
Exit mobile version