হিন্দুধর্মের দাসপ্রথা – একটি সংক্ষিপ্ত দালীলিক উপস্থাপন
হিন্দুধর্মের দাসপ্রথা নিয়ে আলাপ শুরু করলেই অনেক হিন্দু দাবি করে বসে যে, হিন্দুধর্ম সাম্য, মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা বলে। বিশেষ করে প্রোটেস্টেন্ট হিন্দুরা হিন্দুধর্মে বা হিন্দু কালচারে দাস প্রথার অস্তিত্ব অস্বীকার করে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হিন্দু ধর্ম অর্থের বিনিময়ে মানুষকে ক্রয় বিক্রয় করতে , মানুষকে দাসে পরিণত করতে নিষিদ্ধ করেছে। চলুন তাহলে তাদের এই বিশ্বাসকে তাদেরই ধর্মগ্রন্থের আতশ কাচের নিচে রেখে পরীক্ষা করা যাক।
হিন্দুধর্ম মানুষকে দাস বানাতে , ক্রয় বিক্রয় করতে নিষেধ করে এবং মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে এইরকম কাল্পনিক দাবি হিন্দুরা করলেও বাস্তবতা আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় দাস প্রথার কালো ছায়া ভারতীয় সভ্যতার উপর সর্বদা বিরাজমান ছিল।
হিন্দুধর্মের দাসপ্রথার কুফল এবং হিন্দুশাস্ত্রে দাসপ্রথার স্বরূপ
ঋগ্বেদ অনুযায়ী আর্যরা ভারত আক্রমন করে এবং সেখানকার আসল বাসিন্দাদের পরাজিত করে তাদের দাসে পরিণত করে। তারা দাসদাসী ও শুদ্রদের খারাপ নামে ডাকতো এবং তাদের সাথে অমানবিক আচরন করতো । দাসদাসীদের উপহার সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করতো এবং তাদেরকে পশুপ্রানীদের স্তরে গণ্য করা হতো।
ঋগ্বেদে বর্ণিত আছে যে,
“আমাকে একশত গর্দভ, একশত মেষী এবং একশত দাস প্রদান কর।”[1]ঋগ্বেদ 8.56.3
এই শ্লোক থেকে প্রমান হয় যে সেই সময় এইরকম দাসদাসী প্রদান করা স্বাভাবিক বিষয় ছিল।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বর্নীত আছে যে একজন রাজা তার রাজ্যের পুরোহিতকে ১০ হাজার হাতি এবং ১০ হাজার দাসী (slave girls) দান করেন।
“অহে ব্রাহ্মণ তুমি তোমার যজ্ঞে আমাকে আহব্বান করিও আমি তোমাকে দশসহস্র হাতি এবং দশসহস্র দাসী দান করিব”।[2]ঐতরেয় ব্রাহ্মণ 39.8
ঋগ্বেদে অনেক শ্লোক রয়েছে যেগুলো দ্বারা প্রমান হয় যে সুন্দরী মেয়েদের দাসী বানিয়ে পুরোহিতদের প্রদান করা হতো।
যেমন ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে বর্নীত আছে যে,
“হে অগ্নি। চরমানের পুত্র, ঐশ্বৰ্য্যশালী সম্রাট অভ্যবর্ত্তী আমাকে রথ ও রমণী(slave girls) সহকারে বিংশতি গোমিথুন প্রদান করিয়াছেন। পৃথুর বংশধরের এই দান অক্ষয় অর্থাৎ কেহই ইহার বিলোপ করিতে সমর্থ নহে।”[3]ঋগ্বেদ 6.27.8
আরো বর্নীত আছে ঋগ্বেদে,
“স্বনয় কর্তৃক প্রদত্ত ও শ্যামবর্ণ অশ্বযুক্ত বধুসমশ্বিত(কুমারী মেয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ) দশখানি রথ আমার নিকট উপস্থিত হল। এক সহস্র ষষ্টিসংখ্যক গাভী উপস্থিত হল। কক্ষীবান গ্রহণ করে পর দিনেই তা আপনার পিতাকে দান করলেন।”[4]ঋগ্বেদ 1.126.3
ঐতরেয় ব্রাহ্মণের অমানবিক ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ অধ্যায়টা এখানে তুলা ধরা সম্ভব নয় আপনারা বিস্তারিত পড়ে নিবেন আমি শুধু সংক্ষিপ্তভাবে ঘটনাটি আপনাদের সামনে বর্ণনা করছি,
“হারিস চন্দ্র নামে একজন রাজা ছিলেন। তিনি বরুনের উপাসনা করতেন। উনার কোনো সন্তান ছিলোনা। তাই তিনি বরুনের কাছে সন্তান চাইলেন এবং ওয়াদা করলেন যে তিনি এর বিনিময়ে বলি দিবেন। বরুন রাজি হলেন এবং তাকে একটি পুত্র সন্তান দান করলেন যার নাম রুহিত ছিল। হারিশ চন্দ্রের তার কৃত ওয়াদার কথা স্বরণ হলো । তারপর তিনি ঋষি আজিগার্ত্তের পুত্র শুনাশেপকে 100 টি গরুর বিনিময়ে ক্রয় করেন নরবলি দেওয়ার জন্য।”[5]ঐতরেয় ব্রাহ্মণ 7.3
এই ঘটনাটি ভাগবত পুরাণ (9/7), ব্রহ্ম পুরাণ. 104 এবং শঙ্খায়ন (15/17) ও বর্নীত হয়েছে।এই ঘটনা থেকে প্রমান হয় যে মানুষকে তখন দাসদাসী হিসেবে বিক্রি করা হতো এমনকি দাস হিসেবে ক্রয় করে মানুষকে বলিদান দেওয়ার কালচারও প্রচলিত ছিল হিন্দু সভ্যতায়।
ছান্দগ্য উপনিষদে বর্নীত আছে,
“রাজা জনশ্রুতি পৈত্রায়ণ ছয় শত গাভী , কন্ঠহার ও অশ্বতরীযুক্ত রথ এই সমুদয় সম্পদ নিয়ে রৈক্বের নিকট গমন করেন এবং তাহাকে বলিলেন,হে রৈক্ব এই ছয়শত গাভী , এই কন্ঠহার ও এই অশ্বতরীযুক্ত রথ আপনার জন্যে আনা হয়েছে। হে ভগবন ! আমাকে উপদেশ দান করুন আপনি যে দেবতার উপাসনা করেন তার সম্পর্কে। রৈক্ব উপদেশ দিতে অস্বীকার করেন তাই রাজা আবার একহাজার গাভী,হার,অশ্বতরীযুক্ত রথ এবং নিজের কন্যাকে সাথে নিয়ে যান এবং রৈক্বকে বলেন,হে রৈক্ব ! এক সহস্র গাভী,হার , অশ্বতরীযুক্ত রথ এবং আমার কন্যাকে তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। তখন রৈক্ব রাজকন্যাকে উপদেশ দেওয়ার বিনিময় হিসেবে গ্রহন করে বলেন,হে শূদ্র তুমি এতোকিছু আনিয়াছো (রাজকন্যারূপ)উপায় হিসেবেই আমরা আলোচনা করিব।”[6]ছান্দগ্য উপনিষদ 4.2 এবং 4.3
পাঠক উপরের শ্লোকগুলোর দিকে লক্ষ্য করুন, রাজা যখন রৈক্বকে গাভী, অশ্বরথ ও হার দিলেন তখন রৈক্ব রাজাকে উপদেশ দিতে অস্বীকৃতি জানালো তবে যখন রাজা এইসব সম্পদের সাথে নিজের কন্যাকেও বিনিময় হিসেবে দান করলেন তখন রৈক্ব তা উপদেশ দানের বিনিময় হিসেবে গ্রহন করলো। এর থেকে এটা প্রমান হয় যে গাভী , অশ্বরথ ও অন্যান্য সম্পদের মতো নারীদেরকেও বিনিময় হিসেবে প্রদান করা হতো এবং পুরোহীতরা নারীদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে কামনা করতো।
মহাভারত পড়লে হিন্দু ধর্মের দাস প্রথার ধারণা আরো স্বচ্ছ হবে। মহাভারত সভা পর্বে বর্নীত আছে,
“অষ্টআশি হাজার স্নাতক ও গৃহস্থ এবং তাদের প্রত্যেকের ত্রিশটি দাসী যুধিষ্ঠির পালন করেন।”[7]মহাভারত, সভাপর্ব 8.13, রাজশেখর বসু অনুবাদ
পাঠক একবার চিন্তা করে দেখুন প্রত্যেক স্নাতকের জন্য 30 টি দাসী অর্থাৎ মোট 2640000 জন দাসী যুধিষ্ঠির পালন করতেন।
মহাভারত সভা পর্বে বর্ণিত আছে ,
“যুধিষ্ঠির তাদের শত সহস্র ধেন,শয্যা,স্বর্ণ ও দাসী দান করেন”।[8]মহাভারত,সভাপর্ব :7,রাজশেখর বসু অনুবাদ
মহাভারত সভাপর্বে আরো বর্নীত আছে যে,
“যুধিষ্ঠির অলংকার পরিহিত, নৃত্য গীতাদিনীপুনা এক লক্ষ তরুণী দাসী এবং কর্মকুশল, উষ্ণীষকুন্ডলধারী,নম্রস্বভাব এক লক্ষ যুবক দাস ছিল।”[9]মহাভারত,সভাপর্ব :15,রাজশেখর বসু অনুবাদ
পান্ডব সভায় যুধিষ্ঠির জন্য বিভিন্ন দেশের রাজাগণ বিভিন্ন উপহার এনেছিলেন। শুদ্ররা যুধিষ্ঠির জন্য শতসহস্র অর্থাৎ একলক্ষ দাসী এনেছিল উপহার হিসেবে।
এটা বর্নীত আছে মহাভারত সভা পর্বে ,
“শুদ্রেরা কার্পশিকদেশবাসিনী শত সহস্র তন্বী শ্যামা দীর্ঘ কেশী দাসী দিয়েছে”।[10]মহাভারত,সভা পর্ব :13, রাজশেখর বসু অনুবাদ
পাঠক চিন্তা করুন একজন লোক শুধু একটি কিংবা দুটি দাসী নয় বরং হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ দাসদাসী রাখতো নিজের জন্য।
মহাভারত আদি পর্বে বিবাহের যৌতুক হিসেবে দাসী প্রেরণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে ,
“বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কৃতদার পান্ডবদিগের যৌতুকস্বরূপ বিচিত্র বৈদ্ব্ষ্য মণি, স্থুবর্ণের আভরণ, নানাদেশীয়, মহার্হ বসন,রমণীয় শয্যা, বিবিধ গৃহসামগ্রী বহুসংখ্যক দাসদাসী, সুশিক্ষিত গজবৃন্দ, উৎকৃষ্ট ঘটকালী, অসংখ্য রথ এবং কোটি কোটি রঙ্গতকাঞ্চন, শ্রেণাবন্ধ করিয়া প্রেরণ করিলেন।”[11]মহাভারত,আদিপর্ব,বৈবাহিক পর্বাধ্যায়.199
মূলত হিন্দুদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তার বোনের বিবাহে যৌতুক হিসেবে অন্যান্য আসবাবপত্রের পাশাপাশি বহুসংখ্যক দাসদাসী প্রেরন করার কথা এখানে বর্ণীত হয়েছে। পাঠক শুধু এখানেই শেষ নয়। হিন্দুধর্মের ঈশ্বররা যৌতুক হিসেবে শুধু দাসীই প্রেরণ করেননা বরং নিজেরাও বিবাহ করার সময় যৌতুক হিসেবে দাসদাসী গ্রহন করেন। ভগবান রাম সীতাকে বিবাহ করার সময় রাজা জনকের কাছ থেকে যৌতুক হিসেবে দাসদাসী গ্রহন করেন।
বাল্মীকি রামায়নে বর্নীত আছে যে,
“মিথিলাধিপতি বিদেহরাজ জনক কন্যাদিগকে এক লক্ষ গো,অনেক উৎকৃষ্ট কম্বল,অনেক ক্ষৌম বস্ত্র,এক কোটি বস্ত্র,উত্তম উত্তম বহু দাস দাসী,বহু সুবর্ণ,অনেক মুক্তা,বহু বিক্রম সম্যক্ অলংকৃত হস্তী,অশ্ব,সৈন্য এবং সেই সকলকে একশত করিয়া সখী স্বরূপা কন্যা যৌতুক দিলেন।” [12]বাল্মিকী রামায়ণ 74.5
এই শ্লোকগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে আরেকটা বিষয় পরিস্কার হয় যে হিন্দুধর্মের মাধ্যমেই ভারত উপমহাদেশে যৌতুক নামক অভিশাপের সূচনা হয়েছে। আর যৌতুক হিসেবে যদি দাসী প্রদান করা হয় তাহলে এটা আরো অতি নিকৃষ্ট কাজে পরিণত হয়।
এইসকল শ্লোকে যদিও পুরুষ দাসদের বিক্রয় , যৌতুক ও উপহার হিসেবে দেওয়ার কথা বর্নীত হয়েছে তবুও নারীরা (দাসীরা) আত্মসংযমহীন হিন্দুসমাজের অতৃপ্ত লালসার বস্তুতে পরিণত হতো।
প্রাচীন হিন্দুসভ্যতায় নারীদের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ করার জন্য অর্থ সম্পদ দেওয়ার পরিবর্তে নারীদের বন্দক রাখা হতো।
এই সম্পর্কে মহাভারতে একটি ঘটনার বর্ণনা আছে।
এটা বর্নীত আছে মহাভারত উদযোগ পর্বে ,
“ঋষি গালবের কাছে তার গুরু বিশ্বামিত্র দক্ষিণাস্বরূপ আটশত ঘোড়া চান। গালব রাজা যযাতির কাছে এসে আটশত ঘোড়া চান কিন্তু যযাতি গালবকে ঘোড়া না দিয়ে নিজের কন্যা মাধবীকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং কন্যাকে যেকোনো রাজার কাছে বিক্রি করে আটশত ঘোড়া নেওয়ার কথা বলেন এবং গালব সেই প্রস্তাব গ্রহন করেন । যযাতির কন্যা মাধবীকে নিয়ে গালব অযােধ্যার রাজা হর্যশ্বের কাছে গেলেন। তাঁর প্রার্থনা শোনে হর্যশ্ব বললেন, এই কন্যা অতি শুভলক্ষণা, ইনি রাজচক্তবর্তীর পুত্রের জন্ম দিতে পারবেন। কিন্তু আপনি শূল্কস্বরুপ যা চান তেমন অশ্ব (ঘোড়া)দুই শত আমার কাছে আছে । আমি এই কন্যার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করব, আপনি আমার অভীষ্ট পূর্ণ করুন। মাধবী গালবকে বললেন,এক ব্রহমবাদী মূনি আমায় বর দিয়েছেন-তুমি প্রত্যেক বার প্রসবের পর আবার কুমারী হবে। অতএব আপনি দুই শত অশ্ব নিয়ে আমাকে দান করুন; এর পরে আরও তিন রাজার কাছে, আমাকে নিয়ে যাবেন, তাতে আপনার আট শত অশ্ব পূর্ণ হবে, আমারও চার পুত্র লাভ হবে। গালব হযর্শ্বকে বললেন, মহারাজ, আমার শূল্কের চতুর্থাংশ ‘দিয়ে আপনি এই কন়্যার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করুন।যথাকালে হযর্শ্ব বসুমনা নামে একটি পুত্র লাভ করলেন।তখন গালব তার কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনি অভীষ্ট পুত্র পেয়েছেন, এখন অবশিষ্ট শুল্কের জন্য আমাকে অন্য রাজার কাছে যেতে হবে। সত্যবাদী হর্যশ্ব তাঁর প্রতুশ্রুতি অনুসারে মাধবীকে প্রত্যার্পণ করলেন, মাধবী ও পূ্র্ণর্বার কুমারী হয়ে গালবের সঙ্গে চললেন। তারপর গালব একে একে কাশীরাজ দিবোদাস এবং ভোজরাজ উশীনরের কাছে গেলেন।তারাও প্রত্যেক দুই শত অশ্ব দিয়ে মাধবীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করলেন। তাদের পুত্রের নাম যথাক্রমে প্রতর্দন ও শিবি।”[13]মহাভারত,উদযোগপর্ব:15, রাজশেখর বসু অনুবাদ
সুপ্রিয় পাঠক এই হলো তথাকথিত ঋষি ও পুরোহীতদের আসল চরিত্র। এরা নারীদের দাস হিসেবে গ্রহন করে পতিতাবৃত্তি করাতো।
মৎস্য পুরাণে বর্ণিত একটি ঘটনা দেখলে বুঝতে পারবেন কীভাবে দেবতাগণ যুদ্ধের পর বিপক্ষের নারীদের বন্দি করে পতিতাবৃত্তি করাতে বাধ্য করতেন।
মৎস্য পুরাণে বর্ণিত হয়েছে ,
“পুরাকালে দেবাসুর যুদ্ধে , সুরগণের হস্তে বহুশত দানব,অসুর ও দৈত্য ইতস্তত:নিহত হইলে তাহাদিগের শত শত সহস্র সহস্র পত্নীগণকে এবং বলপূর্ব্বক উপভুক্ত অন্যান্য নারীগণকে বাগ্মী বর সুরপতি বলিয়াছিলেন,তোমরা ভক্তিমতী হইয়া অধনা রাজধানী ও দেবপূরী প্রভৃতিতে বেশ্যাধম্ম অবলম্বন পূর্ব্বক অবস্থান কর। রাজাগণ,স্বামীগণ বা তৎপুত্রগণ সকলেই তোমাদের তুল্য হইবে। তোমাদের সুখ সৌভাগ্য ঘটিবে।যেকোনো ব্যাক্তি তোমাদের গৃহে শুল্ক(মূল্য)লইয়া আসিবে,সে দরিদ্র হইলেও তাহাকে তোমরা ভজনা করিবে।”[14]মৎস্যপুরাণ 70:26- 30
ইন্দ্র সেইসকল নারীদের বলে দিচ্ছেন কীভাবে পতিতাবৃত্তি করতে হবে। এটা বর্ণীত আছে মৎস্যপুরাণে,
“পরে সেই বিপ্রকে যথেষ্ট আহার দিয়া রতির নিমিত্ত এই দ্বিজোত্তমই সাক্ষাৎ করিবে। অনন্তর সেই ব্রাহ্মণ যাহ যাহা ইচ্ছা করেন, সেই ব্রতচারিণী বিলাসিনী তাহাই করিবে। স্মিত-পূর্ব-ভাষিণী কামিনী তাহার নিকট সর্বপ্রকারে আত্মসমর্পণ করিবে।”[15]মৎস্যপুরাণ 70:44-45
ভীষ্মও যুদ্ধের পর যুদ্ধবন্দি নারীদের নিজের সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা বর্ণীত আছে মহাভারত আদি পর্বে,
“মহারথ ভীষ্ম ধ্বজাগ্র, বর্ম্ম ও মস্তুকচ্ছেদন করিলেন। তাহার অসা-পারন রণনৈপুণ্য ও যুদ্ধস্থলে আত্মরক্ষা দর্শনে শত্রু-পক্ষীয়েরা ও ভূরি ভূরি ধন্যবাদ করিতে লাগিল। অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ ভীষ্ম ক্রমে ক্রমে সকলকে পরাজয় করিয়া কন্যাদিগের সমাভিব্যাহারে নগরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন।”[16]মহাভারত,আদিপর্ব:102, কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ
একই অধ্যায়ের অন্য জায়গায় বর্ণীত আছে যে ,
“তদনন্তর মহাবীর ভীষ্ম জয়লব্দ সেই সকল কন্যারত্ন লইয়া হস্তিনাপুরে প্রস্থান করিলেন।”[17]মহাভারত,আদিপর্ব:102, কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ
হিন্দুধর্মে দাসী স্ত্রীর মর্যাদা পাবেনা। এটা বর্ণীত আছে বৌধায়ন ধর্মসূত্রে,
“It is laid down that a woman who is purchased for money is not a wife.She cannot take part in rites for gods or ancestors, and Kaśyapa has
declared her to be a slave.”
অনুবাদ :
“এটি নির্ধারণ করা হয়েছে যে,একজন নারী যাকে অর্থ দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে , সে স্ত্রী নয় । দেবতা বা পূর্বপুরুষদের জন্য করা উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারেনা এবং কশ্যপ তাকে দাসী হিসেবে ঘোষণা করেছেন।”[18]বৌধায়ন ধর্মসূত্র : 1.21.3
হিন্দুধর্মে দাস প্রথার শ্রেণীবিভাগ
মনুসংহিতা অনুযায়ী হিন্দুধর্মে দাসপ্রথাকে সাতভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
1. যুদ্ধবন্দী দাস
2. তক্ত দাস : যে ব্যাক্তি স্বেচ্ছায় দাসত্ব স্বীকার করে।
3. গৃহজ দাস : আপন দাসী পুত্র ।
4. ক্রয় কৃত দাস : যে দাসকে ক্রয় করা হয়।
5. পিতা মাতার দেওয়া দাস।
6. উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দাস।
7. রাজার দ্বারা দন্ডিত দাস।[19]মনুসংহিতা 8.415
হিন্দু ধর্মের দাস প্রথা ইসলামের দাসদাসীর বিধানের মতো মানবিক নয়। হিন্দু ধর্মের দাসপ্রথায় ক্রীতদাসদের সন্তান স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাসে পরিণত হবে এবং তাদের পূর্বপুরুষদে মতো একই শর্তে আবদ্ধ হবে। দাস প্রথা শুধু নিছক এক জীবনের ব্যাপার নয় বরং এটি একটি চেইন যেটি যুগের পর যুগ চলবে। হিন্দু ধর্মে দাসদের মুক্তির জন্য কোনো উৎসাহ দেওয়া হয়নি। দাসদের খোলা বাজারে পণ্যের মতো বিক্রি করা হতো ।একজন দাস কেবল তখনই মুক্ত হতে পারে যখন সে মালিককে সেই পরিমাণ অর্থ দিবে আর সেই পরিমান অর্থ একজন দাসের পক্ষে উপার্জন করা সম্ভব ছিলোনা । যদি সে তা উপার্জন করেও নেয় তবুও মালিক বিভিন্ন শর্ত লাগিয়ে দেয়।
হিন্দুধর্মীয় পবিত্র পতিতাবৃত্তি
হিন্দুসভ্যতায় দাসপ্রথার আরেকটি রূপ যা বহুযুগ ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে তা হলো দেবদাসী বা টেম্পল গার্লস। এই দেবদাসীদের ধর্মের দোহাই দিয়ে পতিতাবৃত্তি করানো হয়। এই দেবদাসীরা বিশেষ করে সাউথ ইন্ডিয়ার মন্দির গুলোতে থাকে। তাদেরকে শৈশবকালেই মন্দিরে দান করা হয়। তারা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে মন্দিরের দেবতাদের সাথে তাদের বিবাহ দেওয়া হয় এবং তাদেরকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি করানো হয়।
2004 সালে (the National Human Rights Commission of the Government of India )-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে এখনও দেবদাসীদের অস্তিত্ব আছে।[20]2004,Report by the National Human Rights Commission of the Government of India
এই রিপোর্ট অনুযায়ী
“দেবদাসী হিসাবে দীক্ষা নেওয়ার পরে, মহিলারা পতিতাবৃত্তির জন্য হয় নিকটবর্তী শহরে বা অন্যান্য দূরবর্তী শহরে চলে যায়”।[21]প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা 200
দ্য গার্ডিয়ান-এর 2011 সালের রিপোর্ট অনুযায়ী “ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন অনুমান করে যে ভারতে বর্তমানে 48,358 জন দেবদাসী রয়েছে।”[22]http://www.theguardian.com/lifeandstyle/2011/jan/21/devadasi-india-sex-work-religion
1990 সালের একটি সমীক্ষায় রেকর্ড করা হয়েছে যে একটি নির্দিষ্ট জেলার 45.9% দেবদাসী ছিল পতিতা, অন্যদের অধিকাংশই তাদের আয়ের জন্য কায়িক শ্রম এবং কৃষির উপর নির্ভর করে। 1982 সালে ভারতের কর্ণাটক সরকার এবং 1988 সালে অন্ধ্র প্রদেশ সরকার কর্তৃক দেবদাসী উৎসর্গ করার প্রথা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে 2006 সাল পর্যন্ত উত্তর কর্ণাটকের প্রায় 10টি জেলা এবং অন্ধ্র প্রদেশের 14টি জেলায় এই প্রথাটি প্রচলিত ছিল। হিন্দুধর্মগ্রন্থে দেবদাসী বিধান নিয়ে অন্য কোনোদিন আলোচনা করা যাবে।
সুপ্রিয় পাঠক লেখাটাকে আর দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছিনা। আশাকরি এই লেখা পড়ার মাধ্যমে আপনারা কিছুটা হলেও হিন্দুধর্মের দাস প্রথার বাস্তবতা উপলব্দি করতে পেরেছেন। হিন্দুরা কি এখনও দাবী করবে তাদের ধর্ম সাম্য,মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা বলে এবং তাদের ধর্মে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ? যদি তারা এখনও এমনটা দাবী করে থাকে তাহলে সেটা হবে আত্মপ্রতারণার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহারণ!
Footnotes
⇧1 | ঋগ্বেদ 8.56.3 |
---|---|
⇧2 | ঐতরেয় ব্রাহ্মণ 39.8 |
⇧3 | ঋগ্বেদ 6.27.8 |
⇧4 | ঋগ্বেদ 1.126.3 |
⇧5 | ঐতরেয় ব্রাহ্মণ 7.3 |
⇧6 | ছান্দগ্য উপনিষদ 4.2 এবং 4.3 |
⇧7 | মহাভারত, সভাপর্ব 8.13, রাজশেখর বসু অনুবাদ |
⇧8 | মহাভারত,সভাপর্ব :7,রাজশেখর বসু অনুবাদ |
⇧9 | মহাভারত,সভাপর্ব :15,রাজশেখর বসু অনুবাদ |
⇧10 | মহাভারত,সভা পর্ব :13, রাজশেখর বসু অনুবাদ |
⇧11 | মহাভারত,আদিপর্ব,বৈবাহিক পর্বাধ্যায়.199 |
⇧12 | বাল্মিকী রামায়ণ 74.5 |
⇧13 | মহাভারত,উদযোগপর্ব:15, রাজশেখর বসু অনুবাদ |
⇧14 | মৎস্যপুরাণ 70:26- 30 |
⇧15 | মৎস্যপুরাণ 70:44-45 |
⇧16, ⇧17 | মহাভারত,আদিপর্ব:102, কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ |
⇧18 | বৌধায়ন ধর্মসূত্র : 1.21.3 |
⇧19 | মনুসংহিতা 8.415 |
⇧20 | 2004,Report by the National Human Rights Commission of the Government of India |
⇧21 | প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা 200 |
⇧22 | http://www.theguardian.com/lifeandstyle/2011/jan/21/devadasi-india-sex-work-religion |