বাল্মীকি রামায়ণের “যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধ…” শ্লোকের অর্থ নিয়ে লুকোচুরি!
ভূমিকা
ডঃ অম্বেদকার বলেছিলেন, “ভারতের ইতিহাস হলো বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণদের ইতিহাস।” সেরকম প্রতিটি কণায় কণায়ই পাওয়া যাবে ব্রাহ্মণদের বানানো এই হিন্দুধর্ম ও হিন্দুধর্মগ্রন্থগুলোতে। আজকে বাল্মীকি রামায়ণের একটি শ্লোক নিয়ে আলোচনা করছি। বাল্মীকি রামায়ণের নিচের শ্লোকটি নিয়ে বর্তমান হিন্দু অ্যাপোলোজিস্টদের লুকোচুরির শেষ নেই,
যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধ স্তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি।
তস্মাদ্ধি যঃ শক্যতম প্রজানাং স নাস্তিকে নাভিমুখো বুধঃ স্যাৎ।।[1]বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, সর্গ ১০৯, শ্লোক ৩৪ https://www.prapatti.com/slokas/bengali/Raamaayanam/Ayodhyaakaandam/ayodhyaakaandam_109.pdf
গীতা প্রেস থেকে প্রকাশিত বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদ করা হয়েছে এরকমঃ
‘যেমন চোর, সেইরকম বুদ্ধ (বেদবিরোধী বৌদ্ধ-মতাবলম্বী) তথাগতকে নাস্তিক বলে জানবেন। সেইজন্য প্রজাদের মধ্যে যিনি যোগ্যতম, তিনি কখনও নাস্তিকের অভিমুখী হবেন না।[2]শ্রীমদ্বাল্মীকিয় রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, সর্গ ১০৯, শ্লোক ৩৪, প্রথম খণ্ড, পৃ ৪৭৬, গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর
রামায়ণের এই শ্লোক থেকে যেসব জিনিস প্রমাণিত হয়ে যায়,
- গৌতম বুদ্ধ এবং গৌতম বুদ্ধের অনুসারিদের প্রতি ব্রাহ্মণদের বিদ্বেষ
- বাল্মীকি রামায়ণ গৌতম বুদ্ধের পরে লেখা হয়েছে
এখন নিজেদের টাকমাথা টিকি দিয়ে ঢাকতে অ্যাপোলোজিস্টরা এই শ্লোকের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আর অস্বীকারের অজুহাত দিয়ে থাকেঃ
- এই শ্লোকটি প্রক্ষিপ্ত। আসল বাল্মীকি রামায়ণে এই শ্লোকটি নেই, পরে ঢোকানো হয়েছে। অতএব এমনটা বলার কোনো কারণ নেই যে বাল্মীকি রামায়ণ গৌতম বুদ্ধের পরে লেখা।
- গীতা প্রেস বাদে অন্য কেউ এরকম অনুবাদ করে নি, এটির আসল অনুবাদে ‘বুদ্ধ’ শব্দের অর্থ হবে বুদ্ধিমান ব্যক্তি।
বাল্মীকি রামায়ণ কি গৌতম বুদ্ধের আগে লেখা? শ্লোকটি কি প্রক্ষিপ্ত?
হিন্দুরা দাবি করে তাদের এই বাল্মীকি রামায়ণ নাকি ৭০০০ বছর আগে রচিত, তাদের এসব কল্পকাহিনি নিয়ে নিয়মিত মুভিও বানিয়ে থাকে নিজেরা।
- এখন বাল্মীকি রামায়ণ ৭০০০ বছর আগে রচিত হয়েছে সেটার প্রমাণ হাজির করতে হবে।
না এমন কোনো প্রমাণ তো নাই, উলটো উক্ত শ্লোক এই দাবিকে Disprove/বাতিল করে। সবার আগে জেনে রাখা ভালো যে এই শ্লোককে অস্বীকার করলে কোনোভাবেই বাল্মীকি রামায়ণ ৭০০০ বছর আগে লেখা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয় না। এমন যেসব হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা দাবি করে তারা এখানে Burden of Proof Fallacy খাটায়।
- আসল বাল্মীকি রামায়ণ কোথায়? সেটা যে আসল বাল্মীকি রামায়ণ সেটা কীভাবে প্রমাণ করা হবে?
মূলত আসল কোনো রামায়ণের কপি হাজির করতে পারবে না হিন্দুরা, থাকলে তো পারবে। রামায়ণের প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় এক হাজার সালের দিকের, আর রামায়ণের মূল উৎস বৌদ্ধদের জাতকের নিদর্শন পাওয়া যায় তারও আগের। অ্যাবস্যুলেট অর্থে আসল রামায়ণের কোনো প্রমাণ নেই, বাল্মীকি নামে যে কেউ ছিলো তারও কোনো প্রমাণ নেই, এই শ্লোকটি যে পরে ঢোকানো হয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই।
যাই হোক, আমরা শুধু এতটুকুতেই মনোযোগ দেই, ব্রাহ্মণরা নিজেদের ধর্মগ্রন্থ রচনা করে করে কীভাবে বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার চালিয়ে গেছে, সেটার নমুনা।
অনুবাদে ভুল?
আমরা যদি শ্লোকের দিকে তাকাই, সুন্দরভাবেই “বুদ্ধ স্তথাগতং” দেখতে পাবো, কোথাও কোথাও “বুদ্ধ তথাগতং”। এটা জানা কথা যে তথাগত গৌতম বুদ্ধকেই বলা হয়, এবং তার অনুসারীদের বলা হয়।[3]মহাপরিনির্বাণ সূত্র, বিভাগ ২, অধ্যায় ১৩ তাহলে এখানে “বুদ্ধ” শব্দ দিয়ে যে বুদ্ধিমান কাউকে বলা হয়েছে তা নিমেষেই উড়ে যায়। আমরা দেখি এই শ্লোক নিয়ে অন্যান্য হিন্দু পণ্ডিতরা কী বলছেন…
রামরঞ্জন কাব্যব্যাকরণতীর্থ তার অনুবাদ করেছেন,
চোর যেমন দণ্ডনীয়, বুদ্ধও সেইরূপ, তথাগত বুদ্ধ নাস্তিক বলিয়া মনে করা উচিত। প্রজাগণের বুদ্ধি শুদ্ধির জন্য নাস্তিক- ব্যক্তিকে দণ্ড দান করা রাজার কর্তব্য।[4]বাল্মীকি রামায়ণ, ২/১০৯/৩৪, অনুবাদঃ রামরঞ্জন কাব্যব্যাকরণতীর্থ, পৃ ৫৫৪, আর্য্যশাস্ত্র, সপ্তম সংখ্যা, প্রিন্টঃ ১৯৬৩
এটা প্রমাণ হয়ে গেলো যে এটা শুধু গীতা প্রেসেরই অনুবাদ নয়। আমরা আরো দেখি চলুন,
সরোজাক্ষ নন্দ তার বাল্মীকি রামায়ণ অনুবাদের ভূমিকা অংশে এই শ্লোক উল্লেখ করে এর অর্থ বলেছেন,
(আপনি নাস্তিক) যেমন বুদ্ধ তস্করের মতো দণ্ডার্হ, নাস্তিকও তেমনি জানবেন। তাই যাকে বেদবিরোধী বলে পরিহার করা উচিত পণ্ডিত ব্যক্তি তার সম্মুখীন হবেন না।[5]বাল্মীকি রামায়ণ, নবপত্র প্রকাশন, ভাষান্তরঃ সরোজাক্ষ নন্দ, ভূমিকা অংশ, পৃ xxvii-xxviii
অঘোরনাথ গুপ্ত তার শাক্যমুনিচরিত ও নির্ব্বাণতত্ত্ব কিতাবে লিখেছেন,[6]শাক্যমুনিচরিত ও নির্ব্বাণতত্ত্ব, পৃ ৭ https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.456734/page/n24/mode/1up
এখানে অঘোরনাথ মূলৎ এই শ্লোকের তীলক টীকাটিই বাংলায় উল্লেখ করেছেন উল্লেখ করেছেন,[7]The Ramayana of Valmiki with the Commentary (Tilaka) of Rama, Editor: Parab, Kasinath Pandurang, page 330 https://www.indianculture.gov.in/flipbook/29528 অথবা, https://archive.org/details/The.Ramayana.of.Valmiki.with.Tilaka.of.Rama/page/n360/mode/1up
এই শ্লোকের টীকা দেখে স্পষ্টই হওয়া যাচ্ছে যে ‘বুদ্ধ’ শব্দ দিয়ে ‘বুদ্ধিমান’ জাতীয় কিছু বোঝাচ্ছে না, নাস্তিক-চার্বাক ধর্মের মতো গৌতম বুদ্ধের ধর্মের অনুসারীদের নির্দেশ দিচ্ছে।
গোবিন্দরাজ এই শ্লোকের ভাষ্যেও একই কথা লিখেছেন,
প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদী যদি কশ্চিদ্রাজ্যে স্যাত্ সোপি বহিষ্করণীয ইত্যাহ–যথেত্যাদিনা ৷ চোরো যথা নিরাকরণীয: স: বেদবাহ্যত্বেন প্রসিদ্ধোপি ৷ তথাহি তথৈব ৷ অত্র অস্মিন্ লোকে ৷ নাস্তিকং চার্বাকং তথাগতং বুদ্ধতুল্যং বিদ্ধি তস্মাদ্য: প্রজানাং শঙ্ক্যতম: অবৈদিকত্বেন শঙ্কনীয: ৷ তেন নাস্তিকেন বুধো ভিমুখো ন স্যাত্ ৷৷ 2.109.34 ৷৷[8]https://www.valmiki.iitk.ac.in/commentaries?field_commnetary_tid=14&field_kanda_tid=2&language=as&field_sarga_value=109
মহেশ্বর তীর্থের টীকাঃ
প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদী চার্বাকমতানুসারী জাবালিরিব প্রত্যক্ষমাত্রপ্রমাণবাদী বুদ্ধমতাবলম্বী রাজ্যে যদি কশ্চিত্সম্ভবেত্সোপি নিরাকরণীয ইত্যাহ-যথাহীতি ৷ চোরো যথা নিরাকরণীযঃ স বেদবাহ্যত্বেন প্রসিদ্ধা বুদ্ধঃ তথৈব নিরাকরণীযঃ ৷ অত্র অস্মিংল্লোকে নাস্তীকং চার্বাকমপি তথাগতং বিদ্ধি বুদ্ধতুল্যং বিদ্ধি, তস্মাত্প্রজানাং যঃ শঙ্ক্যতমঃ অবৈদিকত্বেন পরিহর্তব্যঃ ৷ তেন নাস্তিকেন বুধঃ অভিমুখো ন স্যাত্ ৷ শক্যতম ইতি পাঠে বহিষ্কর্তুং চ যোগ্য ইত্যর্থঃ ৷৷ 2.109.34 ৷৷
নাগেশ ভট্টের টীকাঃ
বৌদ্ধাদযো রাজ্ঞশ্চোরবহণ্ড্যা ইত্যাহ-যথা হীতি ৷ বুদ্ধো বুদ্ধমতানুসারী তথা চোরবদ্দণ্ড্য ইতি হি প্রসিদ্ধম্ ৷ নাস্তিকং চার্বাকং তথাগতং তত্সদৃশং চোরবদ্দণ্ড্যং বিদ্ধি ৷ নাস্তিকবিশেষস্তথাগতঃ তমপি চোরবদ্দণ্ড্যমিতি শেষ ইত্যন্যে ৷ বেদপ্রামাণ্যাপহর্তৃত্বেন তেষামপি চোরত্বাত্ ৷ হি নিশ্চযেন তস্মাত্প্রজানামনুগ্রহায রাজ্ঞা চোরবদেব দণ্ডযিতুং শক্যতমো যঃ স চোরবদেব দণ্ড্যঃ দণ্ডাযোগ্যে তু বুধো ব্রাহ্মণো নাস্তিকে ভিমুখো ন স্যাত্ তত্সংভাষণাদি ন কুর্বিতেত্যর্থঃ, তুল্যন্যাযাদ্দণ্ডাসমর্থো ব্রাহ্মণো পি তদ্বিমুখঃ স্যাদিতি সূচিতম্ ৷৷ 2.109.34 ৷৷
উপসংহার
আমরা সবকিছু দেখে এটাই বুঝলাম যে এখানে গৌতম বুদ্ধ আর বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের কথাই বলা হচ্ছে, চোরকে যেমন শাস্তি দিতে হয়, বৌদ্ধদেরকেও সেটাই দিতে হবে।
Footnotes
⇧1 | বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, সর্গ ১০৯, শ্লোক ৩৪ https://www.prapatti.com/slokas/bengali/Raamaayanam/Ayodhyaakaandam/ayodhyaakaandam_109.pdf |
---|---|
⇧2 | শ্রীমদ্বাল্মীকিয় রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, সর্গ ১০৯, শ্লোক ৩৪, প্রথম খণ্ড, পৃ ৪৭৬, গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর |
⇧3 | মহাপরিনির্বাণ সূত্র, বিভাগ ২, অধ্যায় ১৩ |
⇧4 | বাল্মীকি রামায়ণ, ২/১০৯/৩৪, অনুবাদঃ রামরঞ্জন কাব্যব্যাকরণতীর্থ, পৃ ৫৫৪, আর্য্যশাস্ত্র, সপ্তম সংখ্যা, প্রিন্টঃ ১৯৬৩ |
⇧5 | বাল্মীকি রামায়ণ, নবপত্র প্রকাশন, ভাষান্তরঃ সরোজাক্ষ নন্দ, ভূমিকা অংশ, পৃ xxvii-xxviii |
⇧6 | শাক্যমুনিচরিত ও নির্ব্বাণতত্ত্ব, পৃ ৭ https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.456734/page/n24/mode/1up |
⇧7 | The Ramayana of Valmiki with the Commentary (Tilaka) of Rama, Editor: Parab, Kasinath Pandurang, page 330 https://www.indianculture.gov.in/flipbook/29528 অথবা, https://archive.org/details/The.Ramayana.of.Valmiki.with.Tilaka.of.Rama/page/n360/mode/1up |
⇧8 | https://www.valmiki.iitk.ac.in/commentaries?field_commnetary_tid=14&field_kanda_tid=2&language=as&field_sarga_value=109 |
কিন্তু ভাই হিন্দুরা এখানে দাবি করছে এই বুদ্ধ বলতে গোতম বুদ্ধকে নয় এর আগে যারা বুদ্ধ এসেছে তাদের কথা বুঝাচ্ছে।
এই ব্যাপারে কি বলবেন?
তথাগত বুদ্ধ বলতে গৌতম বুদ্ধকেই বোঝায়। আর তীলক টীকা থেকে দেখা যাচ্ছে সেখানে বুদ্ধ মতাবলম্বী/চার্বাক এসব বলা হচ্ছে। যার দ্বারা ব্যাপারটি আরো স্পষ্ট হচ্ছে যে এখানে তথাগত বুদ্ধ ও তার অনুসারীদেরকেই বোঝানো হচ্ছে। (On behalf comment)