নাস্তিকতা কি স্বভাবজাত? নাকি আস্তিকতা?

বিতর্কের উৎস
মুক্তমনা দাবি করা নাস্তিকদের প্রায়ই দাবি করতে দেখা যায় যে, “মানুষের ধর্ম, সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস এগুলোর উৎস পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা ইত্যাদি। সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, এগুলো সহজাতভাবে উঠে আসেনা। বরং পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র তাকে যে বিশ্বাস লালন করতে শিখিয়ে দেয় সে তাই করে। এবং মানুষ সে বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে, পবিত্র বলে মনে করে।”
সুতরাং ধর্ম , সৃষ্টিকর্তা, বলতে আসলে কিছুই নেই।
মুক্তমনা নাস্তিকদের এহেন দাবির কারণ, যদি মানুষের মনে অতি প্রাকৃতিক ভবে কোনো বিশ্বাস থেকে থাকে তাহলে একজন অতি-প্রাকৃতিক সত্তার থাকা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়।
যেহেতু নাস্তিকতা বলতে এমন কিছুকে বুঝানো হয়, যেখানে সৃষ্টিকর্তা বা অতি-প্রাকৃতিক সত্তা বলতে কিছুই থাকতে পারেনা। সেহেতু যদি অতি-প্রাকৃতিক সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হয়ে যায় তাহলে নাস্তিক্যবাদ অচল হয়ে পরবে।
সহজাত বিশ্বাসের প্রমাণ
নাস্তিকদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক? আসলেই কি ধর্ম, সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস আমাদের সমাজ,পরিবার, আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় ? আর আমরা তা অন্ধভাবে মেনে নেই? আমাদের কি সত্য-মিথ্যা বোঝার সহজাত প্রবণতাও নেই?
যদি সত্যি তাই হয় তাহলে নাস্তিকতাই তো ঢের যৌক্তিক !
কিন্তু সত্য এটাই যে নাস্তিকতা স্বভাবজাত কিছু নয় বরং ধর্ম, সৃষ্টিকর্তা,এগুলোই হচ্ছে স্বভাবজাত।
এবং এই সহজাত বিশ্বাসই নাস্তিক্যবাদকে ধুমড়ে মুচড়ে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
একদল শিশুকে কোনো এক জনমানবহীন, শহর থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো একটি দ্বীপে রেখে আসা হলো। সেখানে তারা নিজেরাই বেড়ে উঠতে লাগলো। সেখানে তারা কি এই বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠবে যে জগত অস্তিত্বে আসার জন্য একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব রয়েছে ?
নাকি এমন বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠবে যে এই জগতের অস্তিত্বের জন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই? কিংবা থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই?
একজন নাস্তিক হয়তো খুব সহজেই উত্তর দিবে হ্যাঁ অবশ্যই সে এমন বিশ্বাস নিয়ে জন্ম নিবে যে, জগৎ অস্তিত্বে আসার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই।
কিন্তু কগনিটিভ সাইন্টিস্ট ও গবেষকগণ উল্টো সুরের ফলাফলই পাচ্ছেন!
গবেষকদের দাবি অনুযায়ী শিশুরা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসের পূর্বধারণা নিয়েই জন্মগ্রহন করে। অর্থাৎ শিশুরা প্রাকৃতিক ভাবেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে জন্মায়। তাই ধর্ম, সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস এগুলো পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় আর আমরা তা অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরি নাস্তিকদের এহেন দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
University of Oxford এর Centre for Anthropology and Mind বিভাগের সিনিয়র রিসার্চার Dr. Justin barrott দীর্ঘ ১০ বছর ধরে শিশুদের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে বলেছেন,
“Human beings are natural believers in God.” অর্থাৎ, মানুষ স্বভাবতই ঈশ্বরে বিশ্বাসী।[1]Children are born believers in God, academic claims, Martin Beckford, 24 Nov 2008 – The Telegraph.
বিকল্পঃ Wayback Machine Archive (Accessed on 17 Oct 2021)[2]Are We Born Believers? by Dr. Benjamin Wiker (8 May 2012)
এছাড়া তিনি BBC Radio তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেনঃ
“আপনি যদি কিছু সংখ্যক শিশুকে কোনো দ্বীপে রেখে আসেন আর তারা নিজেরাই বেড়ে উঠে, আমি মনে করি তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করবে।”[3](প্রাগুক্ত) Children are born believers in God, academic claims, Martin Beckford, 24 Nov 2008 – The Telegraph.
এবং Are We Born Believers? by Dr. Benjamin Wiker (8 May 2012)
Dr. Justin barrott তার দীর্ঘ গবেষণার উপর ভিত্তি করে এই বিষয়ের ওপর বইও লিখেছেন; Born Believers: The Science of Children’s Religious Belief শিরোনামে।[4]Justin L. Barrett (2012), Born Believers The Science Of Children’s Religious Belief
সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের মতে,
“যদি নাস্তিকদের শিশু সন্তানদের কোনো মরুদ্বীপে ফেলে রাখা হয়, তাদের মনে একসময় এই বিশ্বাস জাগবে- কেউ না কেউ এই দ্বীপ তৈরি করেছে।”[5]Are we born believing in God? (24 Nov 2008) – TODAY, BBC News UK
একইভাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী Dr. Olivera petrovich পিয়ার রিভিউড জার্নালে তার গবেষণার ফলাফল জানান,
“কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস যে সার্বজনীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (যেমন, কোনো বিমূর্ত সত্তাকে বিশ্বজগতের স্রষ্টা হিসেবে মৌলিক বিশ্বাস), এর পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ ধর্মগ্রন্থের বাণীর চেয়ে বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকেই বেশি বেরিয়ে আসছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।”[6]Key psychological issues in the study of religion, Psihologija Journal 2007 Volume 40, Issue 3, Pages: 351-363
অস্ট্রেলিয়ান একটি নিউজ জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়,
Dr. Olivera Petrovich বলেন, “belief in God is not taught but develops naturally” অর্থাৎ, ঈশ্বরে বিশ্বাস শেখানো হয় না কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হয়। Dr. Olivera Petrovich সাইকোলজি অব রিলিজিয়নের উপর বিশেষজ্ঞ এবং তিনি একজন নাস্তিক।[7]Infants ‘have natural belief in God’ By Barney Zwartz, 28 Jul 2008 – The Sydney Morning Herald
প্রফেসর রবার্ট ম্যাকাওলি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘Why Religion is Natural and Science is not’ গ্রন্থে Dr. Olivera Petrovich এর সুরে সুর মিলিয়েছেন।[8]Why Religion is Natural and Science is Not, Robert N. McCauley, Oxford University Press (2011), page 221
ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষক পল ব্লুম জার্নাল অব ডেভলোপমেন্টাল সাইন্স-এ প্রকাশিত এক পেপারে জানান,
বিগত বছরগুলোতে পরিচালিত কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা জানাচ্ছে কিছু সার্বজনীন ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়েই শিশুরা জন্মায়, যেমনঃ ঐশ্বরিক সত্তার অস্তিত্ব, মহাবিশ্বের ঐশ্বরিক সৃর্ষ্টি, মনের অস্তিত্ব, পরকালের বিশ্বাস ইত্যাদি।[9]Religion is natural by Paul Bloom (2006), Department of Psychology, Yale University, USA – Developmental Science 10:1 (2007), pp 147–151, DOI 10.1111/j.1467-7687.2007.00577.x
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের (নাস্তিক) গবেষক ডেবোরাহ কেলেমেন “শিশুরা কি সহজাতভাবে আস্তিক?” এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ বের করেছেন। এবং সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে,
সম্প্রতি মননগত গবেষণায় দেখা যায় যে, ৫ বছরের দিকে শিশুরা বুঝতে শুরু করে প্রাকৃতিক বস্তু গুলো মানব সৃষ্ট নয়। ৬-১০ বছর বয়সী শিশুরা প্রকৃতির মাঝে একটা মহৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পায়। এসব গবেষণা থেকে শিশুদের ব্যাক্ষ্যামূলক মনোভাবকে সহজাত আস্তিক্যবাদ হিসেবে বলা যেতে পারে। [10]Are Children “Intuitive Theists”? Reasoning About Purpose and Design in Nature. Published in 2004
এছাড়াও ডেভবোরাহ কেলেমেন বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল থেকে সিদ্ধান্ত জানান যে,
“অতিপ্রাকৃতিক সত্তায় ধর্মীয় বিশ্বাস বাহ্যিক, সামাজিক উৎস থেকে নয় বরং, প্রাথমিকভাবে মানুষের ভেতর থেকেই উৎপত্তি হয়। এ বিশ্বাস মানব মনের মৌলিক উপকরণ।” [11]Patrick Mcnamara Ph.D, Wesley J. Wildman (etd.), Science and the World’s Religions, vol. 02 (persons and Groups), p.206,209 (Publisher ABC-CLIO, July 19,2012)
এলিনা জার্নেফেল্ট, কেটলিন এফ.ক্যানফিল্ড এবং ডোবোরাহ কেলেমেন সাম্প্রতি একটি গবেষণা করেছে “অবিশ্বাসীদের বিভক্ত চিন্তাধারা; বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নিধার্মিক প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝে প্রকৃতির উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টির ব্যাপারে সহজ বিশ্বাস” এই শিরোনামে।
এই গবেষণার থেকে জানা যায়, “প্রকৃতিকে পরিকল্পিত হিসেবেই দেখার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে মানুষের”।
গবেষণার ফলাফলটি দেওয়া হয় তিনটি সমিক্ষার মাধ্যমে।
প্রথম সমিক্ষাটি করা হয় ৩৫২ জন প্রাপ্ত বয়স্ক উত্তর-আমেরিকানদের ওপর। দ্বিতীয় সমীক্ষাটি করা হয় ১৪৮ জন উত্তর আমেরিকানদের উপর। এবং তৃতীয় সমীক্ষাটি করা হয় ১৫১ জন ফিনল্যান্ডের বসবাসরত মানুষের মধ্যে।
সমীক্ষায় ধার্মিক এবং অধার্মিক দু-ধরণের লোকই অংশগ্রহণ করেছিলো। তাদেরকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ১২০টি ছবি দেখানো হয়ছিল। এবং তাদের কাজ ছিলো, “ ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে তা কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করেছে কিনা তা নির্ধারণ করা।” তাদের কাউকে কাউকে ঝটপট উত্তর দিতে বলা হয়েছিল এবং কাউকে কাউকে কিছুক্ষণ ভাবার সময় দেওয়া হয়েছিল। কিবোর্ডের মাধ্যমে হ্যা অথনা না ফলাফল দিতে হতো তাদের।
প্রত্যেকটি সমীক্ষা থেকেই প্রাপ্ত ফলাফল এই যে, “নাস্তিকেরাও সৃষ্টির মধ্যে একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পায়।”
এই গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়, প্রকৃতিকে পরিকল্পিত হিসেবে দেখার একটা সহজাত প্রবণতা বা জন্মগত বিশ্বাস আমাদের মাঝে রয়েছে।[12]The divided mind of a disbeliever: Intuitive beliefs about nature as purposefully created among different groups of non-religious adults, 2015 – Sciencedirect
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউজিন নাগাসাওয়া তার বইতে উল্লেখ করেছেন,
”সম্প্রতি কগনেটিভ সাইন্স অব রিলিজিওন ফিল্ডের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা সহজাতভাবে প্রকৃতিতে প্রকৃতিতে উদ্দেশ্য এবং বুদ্ধিমত্তা দেখতে পায়।
সেখানে আরো উল্লেখ করা হয়, মনোবিজ্ঞানি ডোবোরাহ কেলেমেন আমেরিকায় কিছু বিদ্যালয়ের শিশুদের উপর গবেষণা করে জানায় যে শিশুরা সহজাতভাবেই টেলিওলজিক্যাল পরিপ্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক বস্তুর সমূকে ব্যাখ্যা করে।”[13]The Existence of God: A Philosophical Introduction; Page-57-58
সেক্যুলার গবেষক এন্ড্রু নিউবার্গের মতে,
“আমাদের মস্তিষ্ক যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে মানুষের জন্য ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞাতা লাভ খুবই সহজ একটি ব্যাপার, গবেষণার ফল নিঃসন্দেহে সেদিকেই ইঙ্গিত করেছে।”[14]Elizabeth king, I’m an atheist. So why can’t I shake God? The washington post, February 4,2016
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রজার ট্রিগ এর মতে,
“ধর্মকে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা ক্ষণস্থায়ী কারণ ধর্মবিশ্বাস মানব মনে গ্রথিত বলেই প্রতীয়মান হয়।” [15]Tim Ross, Belief in God is part of human nature – Oxford study. The Telegraph, 12 May 2011
বিখ্যাত ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এসেছে,
প্রাথমিক-স্কুল বয়সে, শিশুরা তাদের চারপাশের জগতের জটিলতা ব্যাখ্যা করার জন্য একজন চূড়ান্ত ঈশ্বর-সদৃশ ডিজাইনারকে ডাকতে শুরু করে-এমনকি নাস্তিক হিসাবে বেড়ে ওঠা শিশুরাও![16]Oumanski, P. See Jane Evolve: Picture Books Explain Darwin. Wall Street Journal: Life and Culture. 2014
বিকল্পঃ Wayback Machine কর্তৃক আর্কাইভকৃত ভার্শন, April 19 2014
আর অন্যদিকে নাস্তিক মনোবিজ্ঞানি প্যাসকেল বয়ার Nature জার্নালে প্রকাশিত পেপারে উল্লেখ করেছেন,
“নাস্তিকতা হলো আমাদের সহজাত চেতনার(Natural Cognitive disposition) বিরুদ্ধে।”[17]Pascal Boyer, Bound to Believe? – Nature 2008 ,vol 455, pg 1038-1038
ফিলোসফির দৃষ্টিতে সহজাত বিশ্বাস
সহজাত বিশ্বাসকে ফিলোসফির ভাষায় সেলফ এভিডেন্ড ট্রুথ বা ফাস্ট প্রিন্সিপাল বলে।
এভিডেন্ড ট্রুথ বা ফাস্ট প্রিন্সিপাল কি ?
ফাস্ট প্রিন্সিপাল বলতে বুঝায়, যে সব কিছু আমরা কোনো প্রকার লজিক বা প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করি।
যেমনঃ আমাদের এই মহাবিশ্ব বা ২+২=৪ ইত্যাদি।
যে জীবনকে আমরা বাস্তব বলে মনে করি এই জীবন কি স্রেফ স্বপনের মতো কোনো ব্যাপার ? নাকি আদৌ এর বাস্তব অস্তিত্ব আছে ? আপনি কি কখনো প্রমাণ করতে পারবেন আপনার এই জীবন আসলেই বাস্তব ? আমরা কখনো আমাদের এক্সটার্নাল ওয়ার্ল্ড বাস্তবে অস্তিত্বশীল তা প্রুফ করতে পারবোনা।
যদি আমরা প্রুফ করতে যায় তহলে প্রথমে আমাদের কনসাসনেসকে প্রুফ করতে হবে। তো আমাদের কনসাসনেস নির্ভরযোগ্য এটা কিভবে প্রুফ করবো ? এটাকে প্রুফ করতে হলে আমাদের অন্য একটি কনসাসনেস লাগবে। কিন্তু সেটা পসিবল না।
আমরা এক্সটার্নাল ইউনিভার্স বাস্তবে অস্তিত্বে আছে কিনা তা প্রুফ করতে পারবোনা। কিন্তু এর মানে এই না যে আমরা এক্সটার্নাল ইউনিভার্সের অস্তিত্বকে নাকচ করে দিব। বরং আমরা কোনো যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই প্রকৃতিগত ভাবেই আমরা এই জগতকে বাস্তব বলে মনে করি।
আমরা কারো সাথে কথা বলার সময় যারা সাথে কথা বলি তার অস্তিত্বের প্রমাণ চেয়ে কথা বলিনা। মনে করেন আপনার বন্ধু আপনাকে ডাকতে আসলো বাসায়। তখন নিশ্চয় আপনি তাকে বলেন না যে আগে তুই তোর অস্তিত্বের প্রমাণ দে তাহলে আমি তোর সাথে কথা বলবো! কারণ তুই মানুষ না হয়ে ভিনগ্রহের কোনো প্রাণীও তো হতে পারিস! বা রোবট ও হতে পারিস।
আমরা প্রকৃতিগত ভাবেই বিশ্বাস করি যে আমার বন্ধু আসলেই রিয়েল।
এই যে আমরা কোনো যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই প্রকৃতিগত ভাবেই বিশ্বাস করি নিচ্ছি এটাই হচ্ছে ফাস্ট প্রিন্সিপাল।
সুতরাং প্রকৃতিগত ভাবেই আমরা অনেক কিছুইর উপর বিশ্বাস নিয়ে জন্মগ্রহণ করি।
ইসলামের দৃষ্টিতে সহজাত বিশ্বাস
ইসলামের দৃষ্টিতে সহজাত বিশ্বাসের নাম ফিতরা। এই শব্দটি এসেছে ফাতারা থেকে। ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ফিতরা হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক বিশ্বাস বা জন্মগত বিশবাস।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
কাজেই দ্বীনের প্রতি তোমার মুখমন্ডল নিবদ্ধ কর একনিষ্টভাবে। এটাই আল্লাহ প্রকৃতি, যে প্রকৃতি তিনি মানুষকে দিয়েছেন, আল্লাহর সৃষ্টি কার্যে কোন পরিবর্তন নেই, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।[18]কুরআন, সূরা আর-রুম ৩০:৩০
অন্যত্র বলেছেন,
স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠ হতে তাদের বংশধরদের বের করলেন আর তাদেরকেই সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ; এ ব্যাপারে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’ (এটা এজন্য করা হয়েছিল) যাতে তোমরা ক্বিয়ামাতের দিন না বল যে, ‘এ সম্পর্কে আমরা একেবারেই বে-খবর ছিলাম’।[19]আল-আরাফ, কুরআন ৭:১৭২
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ
প্রত্যেক নবজাতকই ফিত্রাতের উপর জন্মলাভ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহূদী, নাসারা বা মাজূসী (অগ্নিপূজারী) রূপে গড়ে তোলে। যেমন, চতুষ্পদ পশু একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে কোন (জন্মগত) কানকাটা দেখতে পাও? অতঃপর আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) তিলাওয়াত করলেনঃ (যার অর্থ) ‘‘আল্লাহ্র দেয়া ফিত্রাতের অনুসরণ কর, যে ফিত্রাতের উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, এটাই সরল সুদৃঢ় দ্বীন’’- (রুমঃ ৩০)[20]সহিহুল বুখারী ১৩৫৯, মুসলিম ৪৬/৬, হাঃ ২৬৫৮, আহমাদ ৮১৮৫
ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম গাযালি ফিতরাহ সম্পর্কে বলেছেন,
“আল্লাহর ব্যাপারে জ্ঞানের বিষয়টি এমন যে এটা থাকে প্রত্যকে মানুষের চেতনার গভীরে।”[21]কিমিয়ায়ে সাআদাত; দ্যা অ্যালকেমি অভ হ্যাপিনেস, অনুবাদঃ ক্লদ ফিল্ড, কুয়ালালামপুর, ইসলামি বুক ট্রাস্ট,পৃষ্ঠা ৩৪২
এছাড়া, বিখ্যাত মনীষী ইবনু তাইমিয়্যা ফিতরা সম্পর্কে বলেছেন,
“ফিতরাহ থেকেই একজন নিপুণ স্রষ্টার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই জ্ঞান অমোচনীয়,অনিবার্য এবং সুস্পষ্ট।”[22]মাজমু আল-ফাতওয়া শাইখুল ইসলাম আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যা, মাদিনা; মুজামা’মালিক হাদাদ (১৬/৩২৪)
এছাড়াও, ইবনু তাইমিয়্যা ফিতরা সম্পর্কে বলেছেন,
“একজন সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস সকল মানুষের অন্তরে গাঁথা আছে, একটা তাদের সৃষ্টির আবশ্যিক শর্ত থেকে।”[23]দার তারুদ আল-আকল ওয়ান-নাকল, ২য় সংস্করণ, সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ রাশাদ সালিম, জামিআ আল-মুহাম্মদ বিন সাউদ আল-ইসলামিয়া। খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ৪৮২
বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ শায়েখ সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ.) ফিতরাত সম্পর্কে বলেন,
“যে মানুষ আল্লাহকে চেনেনা, যে তাকে অস্বীকার করে, যে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে পূজা করে এবং আল্লাহর কর্তিতবের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে অংশীদার করে, স্বভাব প্রকৃতির (ফিতরাত) দিক দিয়ে সেও মুসলিম, কারণ তার জীবন মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহর বিধানের অনুসারী।….. যে মাথাকে জোরপূর্বক আল্লাহ ছাড়া অপরের সামনে অবনত করছে, সেও জন্মগতভাবে মুসলিম, অজ্ঞতার বশে যে হৃদয় মধ্যে সে অপরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা পোষণ করে,তাও সহজাত প্রকৃতিতে মুসলিম।[24]সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী; ইসলাম পরিচিতি, পৃষ্টা নং- ৮
নাস্তিকতা কি স্বভাবজাত?
নাস্তিকতা কোনো সহজাত বিশ্বাস বা জন্মগত বিশ্বাস নয়।
নাস্তিক হতে হলে সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করতেই হবে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা ও ফিলোসফিক্যাল আর্গুমেন্ট থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস আমাদের জন্মগত বিশ্বাস।
তো জন্মগত কোনো বিশ্বাস বা সহজাত বিশ্বাসের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হলে তা অবশ্যই “অর্জিত অবস্থানই হবে”। আর এখানে “প্রমাণের অভাবে স্রষ্টাকে অস্বীকার”-এই যুক্তিটিও খাটলো না, স্বতঃসিদ্ধকে ডিসপ্রুভ করা যায় না। চাইলে অন্ধবিশ্বাসীরা চেষ্টা করে দেখতে পারেন!
যেহেতু আমরা প্রাথমিক ভাবে একজন সৃর্ষ্টিকর্তার বিশ্বাস পেয়ে থাকি সেহেতু সৃষ্টিকর্তার প্রমাণ আছে কিনা এমন প্রশ্নের পরিবর্তে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে সৃষ্টিকর্তা যে নাই সেটার কোনো প্রমাণ আছে কিনা?
আপনাকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে,
হে মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক সম্পর্কে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে? [25]কুরআন, সূরা আল-ইনফিতার ৮২:৬
এবং আল্লাহই ভালো জানেন।
পোস্টটি মূল উৎস থেকে পড়ুনঃ Faith-and-theology.com
আমাদের অন্যান্য লেখা পড়ুন।[26]সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছেয় হলে আমি শাস্তি পাবো কেন?