আদম (আঃ)-কে কি শ্রীলংকায় অবতরণ করানো হয়েছিল?
আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) উভয়কে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে অবতরণ করানো হয়েছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। সাথে ইবলিসকেও নামানো হয়েছিল তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তবে জমিনের কাকে কোথায় নামানো হয়েছিল? এবং কোথায় তারা মিলিত হয়েছিল?
সে ব্যপারে সহিহ সূত্রে কিছু বর্ণিত নেই। তবে কিছু অতি দুর্বল রেওয়ায়েত পাওয়া যায়। আসুন, আমরা এ ব্যপারে বর্ণনাগুলো দেখি এবং নবীদের গ্রহণযোগ্য ইতিহাস লেখকদের বক্তব্য শুনি। তার আগে জেনে নিই এ ব্যপারে কী কী মত (দলিল নয়) বর্ণিত আছে,
- আদম (আঃ) হিন্দে (হিন্দুস্তানে) এবং হাওয়া (আঃ)-কে জিদ্দায় অবতারণ করানো হয়েছিল।
- উভয়কেই হিন্দুস্তানে নামানো হয়েছিল।
- আদম (আঃ) কে ‘দাহনা’ নামক মক্কা ও তায়েফের মাঝে এক স্থানে নামানো হয়েছিল।
- আদম(আ)-কে সাফা এবং হাওয়া(আ) কে মারওয়া পাহাড়ে নামানো হয়েছিল।
বর্ণনা এবং মুফাসসিরদের মত
ইবনে আসাকির (রাহিঃ) বর্ণনা করেছেন,
نزل آدم الهند واستوحش–
“আদম (আঃ) হিন্দে অবতারণ করেন এবং উনি একাকীত্ব অনুভব করেন।…”[1]তারিখে দামিশ্ক ৭/৪৩৭
মানঃ দুর্বল[2]সিলসিলাতুল আহাদিসে দয়ীফাঃ( ৪০৩ নং হাদিস).
#ইমাম ইবনে কাসির (রাহিঃ) বলেন,
ইমাম সূদ্দী “তোমরা সকলে নেমে যাও” এই আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, ‘আদম (আঃ) হিন্দে হজরে আসওয়াদ সহ অবতারণ করেন।…।[3]তাফসিরে ইবনে কাসিরঃ ১/৩৬৮
হাসান বসরি (রাহিঃ) বলেন,
“আদমকে (আঃ) হিন্দে, হাওয়াকে (আঃ) জিদ্দায়, ইবলিসকে বসরার (ইরাকের) কয়েক মাইল দূরে ‘দাসতামিসাননে’ নামানো হয় এবং সাপটিকে ইসপাহান (ইরানে) নামানো হয়।”[4]তাফসিরে ইবনে আবি হাতিমঃ ১/১৩২
ইবনে ওমর (রাদিঃ) বলেন,
“আদম (আঃ) কে সাফা এবং হাওয়া (আঃ)-কে মারওয়া পাহাড়ে নামানো হয়।”[5]তাফসিরে ইবনে আবি হাতিমঃ ১/১৩১
ইবনে আব্বাস (রাদিঃ) বলেন,
“আদম (আঃ)-কে মক্কা এবং তায়েফের মধ্যবর্তী ‘দাহনা’ নামক স্থানে নামানো হয়।”[6]তাফসিরে ইবনে আবি হাতিমঃ ১/১৩২
নবীদের ইতিহাস লেখকদের মন্তব্য
‘কসাসুল কুরআন‘-এর বিশিষ্ট লেখক মাওলানা হিফজুর রহমান সিওহারবি (রাহিঃ) উপরের মতগুলো উল্লেখ করার পর দারুন সুন্দর কথা লিখেছেন। উনি লিখেছেন,
”কিন্তু কুরআন মাজিদ ঘটনার এক অংশটি সম্পর্কে নীরব রয়েছে। কারণ এই বিষয়টি প্রকাশ করার সঙ্গে হেদায়েত ও নসিহতের কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্য অন্তরের প্রবল ধারণা এ-দিকে ধাবিত হয় যে, হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ) একই স্থানে অবতারিত হয়ে থাকবেন। কেননা, তাহলে আল্লাহ তাআলার পূর্ণ হেকমতের চাহিদা অনুযায়ী সত্বরই মানবজাতির বংশবৃদ্ধির কাজ শুরু হতে পারবে। এই জড়জগতের উত্তরাধিকারী ও অধিবাসীরা জমিনকে আবাদ করে মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দুনিয়ার খেলাফতের পুরোপুরি হক আদায় করতে পারবে।”[7]কসাসুল কুরআনঃ ১/৪৫, মাকতাবাতুল ইসলাম, বাংলাদেশ
আরবের খ্যাতিমান নবীদের ইতিহাস লেখক ড সালাহ খালেদী (রাহিঃ) বলেন,
”জমিনের কোন স্থানে তাদেরকে নামানো হয় এবং তারা কোন ভূখণ্ডে জীবন শুরু করেন, এগুলো অস্পষ্ট, অনির্ধারিত এবং নস বা কোরআন-সুন্নাহ বা সহিহ ইতিহাসের মাধ্যমে নির্দিষ্ট নয়। তাই আমরা তার সীমা নির্ধারণ, নির্দিষ্ট করতে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হব না। এবং এ জন্য ইসরাঈলী রেওয়াত ও গালগল্পর দিকে ছুটব না। বরং স্পষ্ট আয়াত ও সহিহ হাদিস পর্যন্ত থেমে থাকব। যেটুকু পাব সেটুকু বলব এবং যা পাব না সে ব্যপারে চুপ থাকব।”[8]কাসাসুল কুরআনীয়াঃ ১/ ১৩৭
শায়েখ মুহাম্মদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিঃ) এই বিষয়ে লেখেছেন,
وما صح في هذا الشأن إنما هي أقوال لبعض السلف ، الغالب أنهم أخذوها من علوم أهل الكتاب المنقولة في زمانهم ، ومثل هذه الأخبار لا يعتمد عليها ، ولا يوثق بها ، ولا يجوز الإيمان بما جاء فيها مما سكتت عنه شريعتنا ، وإنما تروى وتحكى للاستئناس فقط
“…অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা এই জাতীয় গল্পগুলো তাদের যুগে আহলে কিতাবদের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে গ্রহণ করতেন। যার উপর ভরসা বা নির্ভর করা যায় না। এবং আমাদের শরীয়ত যে ব্যপারে চুপ সে ব্যপারে ইমান আনা বা দৃঢ়ভাবে বলা অথবা বিশ্বাস করা যায় না। তবে এগুলো বর্ণনা করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো অন্যদেরকে তাদের বক্তব্যের সাথে পরিচয় করানো।”[9]ইসলামকিউএ, ১৪১২৮০ নং ফাতাওয়া
আরবিঃ https://islamqa.info/ar/answers/141280/
ইংরেজিঃ https://islamqa.info/en/answers/141280/
আদম-হাওয়া (আঃ) কোথায় মিলিত হয়েছিল?
কথিত আছে যে, “তারপর এক দীর্ঘকাল পরে তারা দুজনই হেজাযের আরাফাত নামক স্থানে একত্রে মিলিত হলেন। এ-কারণে হজের এই ময়দানটির নাম হয়েছে আরাফাত (জানাশোনা)। কেননা, এখানে তারা পরস্পর মিলিত হয়ে একে অপরকে চিনতে পেরেছিলেন।”[10]কসাসুল কুরআনঃ ১/৪৫, মাকতাবাতুল ইসলাম, বাংলাদেশ
এ কথারও কোনো প্রমাণ নেই। কেবল মন্তব্য বা মত মাত্র।
লেখকঃ আব্দুর রহমান
Footnotes
⇧1 | তারিখে দামিশ্ক ৭/৪৩৭ |
---|---|
⇧2 | সিলসিলাতুল আহাদিসে দয়ীফাঃ( ৪০৩ নং হাদিস). |
⇧3 | তাফসিরে ইবনে কাসিরঃ ১/৩৬৮ |
⇧4, ⇧6 | তাফসিরে ইবনে আবি হাতিমঃ ১/১৩২ |
⇧5 | তাফসিরে ইবনে আবি হাতিমঃ ১/১৩১ |
⇧7, ⇧10 | কসাসুল কুরআনঃ ১/৪৫, মাকতাবাতুল ইসলাম, বাংলাদেশ |
⇧8 | কাসাসুল কুরআনীয়াঃ ১/ ১৩৭ |
⇧9 | ইসলামকিউএ, ১৪১২৮০ নং ফাতাওয়া |
ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব লিখেছেন,
“আদম ও হাওয়াকে আসমানে অবস্থিত জান্নাত থেকে নামিয়ে দুনিয়ায় কোথায় রাখা হয়েছিল, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে আদমকে সরনদীপে (শ্রীলংকা) ও হাওয়াকে জেদ্দায় (সঊদী আরব) এবং ইবলীসকে বছরায় (ইরাক) ও ইবলাসের জান্নাতে ঢোকার কথিত বাহন সাপকে ইস্ফাহানে (ইরান) নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেউ বলেছেন, আদমকে মক্কার ছাফা পাহাড়ে এবং হাওয়াকে মারওয়া পাহাড়ে নামানো হয়েছিল। এছাড়া আরও বক্তব্য এসেছে। তবে যেহেতু কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি, সেকারণ এ বিষয়ে আমাদের চুপ থাকাই শ্রেয়।”
– নবীদের কাহিনী, ১. হযরত আদম (আলাইহি ওয়াসাল্লাম), আদমের অবতরণ স্থল
https://www.hadithbd.com/books/link/?id=2160
মাসিক আত-তাহরীক থেকেঃ
প্রশ্ন (৪০/৪০) : হযরত আদম (আঃ) শ্রীলংকায় অবতরণ করেছিলেন মর্মে যে জনশ্রুতি রয়েছে তা কতটুকু নির্ভরযোগ্য? অথচ এর উপর ভিত্তি করে ‘আদম্স পিক’ নামে সেখানে একটি পাহাড়কে অবতরণস্থল হিসাবে গণ্য করে মাযার বানিয়ে লোকেরা পূজা করছে।
উত্তর : ছহীহ দলীলের দৃষ্টিকোণ থেকে এর কোন ভিত্তি নেই। তবে মক্কার না‘মান উপত্যকায় (বর্তমান আরাফা ময়দানে) আল্লাহ আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল আদম সন্তানের রূহ ও পিপীলিকাসদৃশ দেহ হাযির করে তাদের কাছ থেকে ‘আহদে আলাস্ত্ত’ অর্থাৎ আল্লাহর প্রভুত্বের স্বীকৃতি ও তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন (আ‘রাফ ১৭২-৭৩; আহমাদ হা/২৪৫৫; মিশকাত হা/১২১)। সে হিসাবে ধারণা করা যায় যে, তিনি মক্কায় অবতরণ করেছিলেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
— মাসিক আত-তাহরীক, অক্টোবর ২০১৩ https://at-tahreek.com/article_details/6366