আওরঙ্গজেব আলমগীরঃ ভিন্ন চোখে ভিন্নভাবে
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় পূত্র আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭)। পিতার জীবদ্দশায় সংঘটিত উত্তরাধিকার সংগ্রামে সুনিপুণ কুটনৈতিক জ্ঞান, ও বীরত্বের দ্বারা আওরঙ্গজেব মুঘল সিংহাসন অধিকার করতে পেরেছিলেন। আওরঙ্গজেব একজন শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন, তিনি প্রায় ৫০ বছর রাজত্ব করেন। ইতিহাসে তাঁকে ইসলামের বরপুত্র ও জিন্দাপীরও বলা হয়।
তিনি নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা, কঠিন মনোবলের দ্বারা কঠিন পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে সফলভাবে সাম্রাজ্য পরিচালনা করে দেখাতেও পেরেছিলেন।
তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয় একজন সম্রাট। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের ‘মুঘল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ থেকে তাঁর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়। সেটা হলো, আওরঙ্গজেব প্রতিদিন সকালে ‘দেওয়ানি আম’-এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রজাদের দর্শন দিতেন। কিন্তু এটা ব্যক্তিপূজা প্রথায় পরিণত হতে পারে এই ভেবে তিনি এই দর্শন প্রথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রজাগণ প্রতিদিন দর্শনলাভের আশায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী কিছু প্রজা রাজার মুখদর্শন না করা পর্যন্ত সকালে জলস্পর্শ করতেন না।শেষে প্রজাদের অনুরোধে তাঁকে আবারও ঐ দর্শনপ্রথা চালু করতে হয়েছিল।[1]আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩১৪
এর দ্বারা সহজেই বোঝা যায় প্রজাদের মধ্যে তাঁর কীরূপ জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই আওরঙ্গজেবকেই প্রচলিত ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সম্রাট ও ঘৃণার পাত্র হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
আওরঙ্গজেবের উপর অভিযোগ ও তার সত্যতা
তাঁর উপর আরোপ করা অভিযোগগুলি মোটাদাগে হল—
- জিজিয়া কর
- মন্দির ধ্বংস
- হিন্দু বিদ্বেষ ও ধর্মান্তরকরণ।
তো চলুন দেখা যাক এগুলো কতটা সত্যি…
তাঁর উপর যে-সব ঐতিহাসিকরা মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্যার যদুনাথ সরকার। স্যার যদুনাথ সরকার সম্পর্কে আধুনিক গবেষক অড্রে ট্রুস্কে বলেন―
“বহুকাল ধরে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে যদুনাথ ছিলেন শেষকথা। তাঁর আগে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বিশদ গবেষণা কেউ করেননি। আস্তে আস্তে যখন গবেষকেরা আওরঙ্গজেবের সময় জানতে ও বুঝতে শুরু করলেন তখন দেখা গেলো আওরঙ্গজেবকে যদুনাথ যেভাবে উপস্থাপন করেছেন মানুষটা তার থেকে অনেকটা আলাদা।”[2]অড্রে ট্রুস্কে,আওরঙ্গজেবঃ ম্যান এন্ড দ্য মিথ,পৃ ১৩৮
গবেষক অড্রে ট্রুস্কে তার বিখ্যাত বই “Aurangzeb: The Man and The Myth” এ বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছেন আওরঙ্গজেবকে নিয়ে কিরকম প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়েছে প্রচলিত ইতিহাস বইগুলোতে। তিনি আওরঙ্গজেব নিয়ে অসাধারণ একটা কাজ করেছেন বলা যায়।
জিজিয়া কর
আওরঙ্গজেবের উপর প্রধান অভিযোগগুলোর একটা হলো – জিজিয়া কর।
জিজিয়া করকে ঐতিহাসিকরা হিন্দু বিদ্বেষ বলে প্রচার করে থাকেন।কিন্তু জিজিয়া কোন হিন্দু বিদ্বেষী কর না, এটা ইসলামি রাষ্ট্রের একটা কর। আসলে ইসলামি রাষ্ট্রে কোন অমুসলিম বসবাস করলে তাকে একটা কর বা ট্যাক্স দিতে হয় সেটার নাম হচ্ছে জিজিয়া কর। আর এর বিনিময়ে সে তার জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে রাষ্ট্র থেকে।আর এটা মূলত যুদ্ধ কর। এই কর থেকে নারী, শিশু, সন্ন্যাসী ও পুরোহিতরা মুক্ত। আর এটা মাথাপিছু করও নয়। আর করটা খুব মোটা অংকেরও না।[3]জিজিয়া কি আসলেই শোষণমূলক বিধান? – মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার, Response-To-Anti-Islam https://links.frommuslims.com/weS
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো ইতিহাসে দেখা যায় ঔরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহণের ২২ বছর পর জিজিয়া চালু (১৬৭৯) করেছিলেন। শিবলি নোমানি রচিত ‘আল জিজিয়া’ গ্রন্থে ও সতীশচন্দ্রের ‘জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র’ প্রবন্ধে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।[4]শিবলি নোমানি, আল জিজিয়া। সতীশচন্দ্র, জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র, আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত
এবার প্রশ্ন ওঠে জিজিয়া যদি হিন্দু বিরোধী করই হয় বা আওরঙ্গজেব যদি হিন্দু বিরোধীই হতেন তাহলে তিনি জিজিয়ার জন্য ২২ বছর অপেক্ষা কেন করলেন?
বেশকিছু ঐতিহাসিক অভিযোগ করেছেন জিজিয়া কর চাপানোর কারণ ছিলো হিন্দুদের চাপে ফেলে ইসলাম গ্রহণ করানো কিন্তু সমস্যা হলো গিয়ে কেউ অমুসলিম থেকে মুসলিম হলে সে জিজিয়া করের আওতা থেকে বের হয়ে জাকাতসহ আরো বেশকিছু করের আওতায় চলে আসে যার পরিমাণও বেশি। সুতরাং এটা একটা ফালতু যুক্তি।[5]আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ২৯৮.
সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, ১৬৭৯-র পরে অর্থাৎ জিজিয়া পুনর্বহালের পর থেকে আমির-ওমরাহদের বিভিন্ন স্তরে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যায়নি, বরং বেড়েছিল। আতাহার আলি ‘মুঘল নোবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে ১৬৫৮-১৬৭৮ সালের মধ্যে ৫১ জন বড়ো অভিজাতদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ১০ জন, কিন্তু ১৬৭৯-১৭০৭ সালের মধ্যে ৭৯ জন বড়ো অভিজাতদের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন হিন্দু অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ। কাজেই এক্ষেত্রে জিজিয়াকে হিন্দু বিদ্বেষের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরাটা একটা ফালতু বয়ান।[6]আতাহার আলি, দ্য মুঘল নোবলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, পৃ ৩৯. আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত
এমনকি জিজিয়া মকুব হতো এই তথ্যও পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র তাঁর গ্রন্থে বলেছেন,
“আওরঙ্গজেবের আমলে পাঞ্জাবের একটি গ্রামে জিজিয়া কর ধার্য সংক্রান্ত দলিল থেকে দেখা যায় যে, ২৮০ জনের মধ্যে ৭৩ জনকে নানারকম কারণের জন্য জিজিয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে।”
এ ছাড়া ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধজনিত কারণে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের জিজিয়া মুকুব করা হয়েছিল। ফসল উৎপাদন খারাপ হলেও জিজিয়া মুকুব করা হত। ১৬৮৮-৮৯ সালে হায়দ্রাবাদ সুবায় খরার জন্য এক বছরের জিজিয়া মকুব করা হয়েছিল।[7]আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩০৩.
এছাড়া গোলাম আহমেদ মোর্তজা তাঁর গবেষণায় দেখিয়ে গেছেন ইসলাম-পূর্ব হিন্দু ভারতেও ধর্মীয় ট্যাক্স ছিলো।
মন্দির ধ্বংস
এবিষয়ে গবেষক অড্রে ট্রুস্কে এবিষয়ে বলেন –
“… আওরঙ্গজেব হাজারে হাজারে মন্দির ধ্বংস করেননি (খুব বেশি হলে এক ডজন হবে হয়ত)।”[8]অড্রে ট্রুস্কে, পূর্বোক্ত, পৃ ৫১
আর সেসমস্ত মন্দিরগুলো ধ্বংস করা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। কারণ সেগুলো ষড়যন্ত্রের আখড়া হয়ে উঠেছিল। আর তিনি বারো চৌদ্দোটা মত মন্দির ধ্বংস করলেও তার চেয়ে বেশি মন্দির রক্ষা করেছিলেন।[9]অড্রে ট্রুস্কে, পূর্বোক্ত, পৃ ১০৭
আর তিনি যে-কারণে (রাজনৈতিক) মন্দির ধ্বংস করেছিলেন সেই একই কারণে অতীতে হিন্দু রাজারাও মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, হরবংশ মুখিয়া দেখিয়েছেন, “মুসলমান আক্রমণের বহু আগেই অনেক হিন্দু শাসক তাদের শত্রু এলাকায় গিয়ে একই কাজ করেছেন।”[10]থাপার, মুখিয়া ও চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, পৃ ৪১
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও আওরঙ্গজেবের উপর আরোপিত অপবাদের বিরোধিতা করে বলেন –
“কাশীর বিশ্বেশ্বর মন্দির আওরঞ্জেবের একজন সুবেদার ভাঙিয়ে দেন, মন্দির ভাঙার জন্য আওরঞ্জেব সুবেদারকে খুব ধমক দিয়াছিলেন। তাহার সেই ধমকের পত্রটি সম্প্রতি বাহির হইয়াছে ও ছাপ হইয়াছে।”[11]হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, হিন্দুর মুখে আরঞ্জেবের কথা’, প্রবাসী, জৈষ্ঠ্য ১৩২২, ১ম খণ্ড, ২ সংখ্যা, (আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত)
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় তিনি বহু মন্দিরের জন্য জমি দান করেছিলেন। ১৬৫৯ থেকে ১৬৯৯-র মধ্যে আওরঙ্গজেব অযোধ্যার দস্তধাবন মন্দির, আমেদাবাদের শত্রুঞ্জয় জৈন মন্দির,এলাহাবাদের সোমেশ্বরনাথ মহাদেব মন্দির, কাশীর জঙ্গমবাড়ীর শিব মন্দির, ভারতের প্রাচীনতম নাগেশ্বর মন্দির, উজ্জয়িনীর মহাকালেরশ্বর মন্দির, চিত্রকুটের বালাজি মন্দির, গুয়াহাটির উমানন্দ মন্দির, মহারাষ্ট্রের নানদেড় জেলার মোহনপুরের দত্তাত্রেয় গুরু মন্দির, আবু পাহাড়ে অবস্থিত মন্দির, জুনাগড়ের মন্দির এবং বিভিন্ন শিখ গুরুদ্বারসহ প্রভৃতি ধর্মীয় উপাসনাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে ফরমান জারি করে জায়গির দান করেছিলেন।
রেখা যোশী তাঁর “Aurangzeb, Attitudes and Inclinations” গ্রন্থে জানিয়েছেন যে, কাশীর বাঙালিটোলায় রক্ষিত ঔরঙ্গজেবের ফরমান থেকে এটা স্পষ্টায়িত হয় যে, তিনি ওই মঠের জন্য তিনবার অর্থদান, ভূমিদান ও আগেকার তিনটি অনুদানকে পুনরায় কার্যকরী করেন।[12]আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩১৫.
এ ধরনের ৪৮টি দানপত্র সংগ্রহ করেছেন কে কে দত্ত তাঁর গ্রন্থে। এই অনুদানগুলি সবই ছিল নিঃশর্ত ও স্থায়ী।[13]আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা
আওরঙ্গজেব শৈব সম্প্রদায়ের জন্যও বহু নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। এই মন্দিরের জন্য জমিদানের তালিকা বেশ বৃহৎ। এ বিষয়ে আরো জানতে জ্ঞানচন্দ্রের Aurangzeb and The Hindu Temples এবং Alamgir’s Petronas and The Hindu Temples পড়া যেতে পারে।
হিন্দু বিদ্বেষ ও ধর্মান্তরকরণ
আরো একটা অভিযোগ হিন্দুদের জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করানো। এই বিষয়ে অড্রে ট্রুস্কে বলেন –
“… তিনি কখনোই কোন অমুসলিমকে তলোয়ারের আঘাত না ইসলাম এটা বেছে নিতে বাধ্য করেননি বা গণধর্মান্তরকরণ করেননি। ….হিন্দুদের গণহত্যা করার আশেপাশেও যাননি।বরং তিনি হিন্দুদের উচ্চপদে কাজ দিয়েছেন।”[14]অড্রে ট্রুস্কে, আওরঙ্গজেবঃ ম্যান এন্ড দ্য মিথ,পৃ ৫১
তিনি দেখান আকবরের সময়কালে আমলাতন্ত্রে হিন্দু আমলাদের সংখ্যা ছিলো ২১.৫% কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময়ে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩১.৬% তে।[15]অড্রে ট্রুস্কে,পূর্বোক্ত, পৃ ৮৭
সম্রাটের প্রধান দুই সেনাপতিও ছিলো হিন্দু। জয়সিংহ ও যশোবন্ত সিংহ। ঔরঙ্গজেব জয়সিংহ ও যশবন্ত সিংহকে ৭০০০ মনসব পদে উন্নীত করেছিলেন।আর আশ্চর্যের বিষয় হলো যশোবন্ত সিংহের ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে ভূমিকা সত্ত্বেও তাঁকে ৭০০০ মনসবদার পদে নিয়োগ করা হয়েছিল।
এছাড়াও তাঁর আমলে বহু হিন্দুকে উচ্চপদে চাকুরি দেওয়া হয়েছে, যেমন: রাজা ভিম সিংহ, ইঙ্গ সিংহ, বাহাদুর সিংহ,শিবাজির জামাতা রাজা মানসিংহ, শিবাজির জামাতা আচলাজি, শিবাজি-পুত্র শম্ভাজির চাচাতো ভাই আরজোজি সহ আরো বহুজনকে।
আরো একটা বিষয় হলো আকবর ও জাহাঙ্গিরের শাসনামলের তুলনায় আওরঙ্গজেবের আমলে সেনাবাহিনীর সালার পদে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি ছিল। এই বিষয়টি ড. ওম প্রকাশ প্রসাদের ‘আওরঙ্গজেব আওর উসকা নজরিয়াহ’ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে।
স্ট্যানলি লেনপুল আওরঙ্গজেব বিষয়ে বলেন―
Throughout his long region of nearly fifty years no single dead of cruelty has been proved against him.even his persecution of the hindus, which was of a piece with his puritanical character, was admittedly marked by no executions or tortures.[16]Stanley Lane Poole, Rulers of India, Aurangzeb Part Delhi, p 64, আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত
জ্ঞানচন্দ্র তাঁর প্রবন্ধে বার্নিয়ের রেফারেন্স দিয়ে হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের উদারতা ও সহনশীলতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন, এবং বলেছেন, ঔরঙ্গজেব মোটেও হিন্দুদের কাছে ভীতিকর ছিলেন না আর অত্যাচারীও ছিলেন না।[17]আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩৩০
এমনকি আওরঙ্গজেব মহারাজা যশোবন্ত সিংহ ও রাজা জয়সিংহের জীবদ্দশায় দশেরা উৎসব করতেন বলেও জানা যায়।[18]মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক, পৃ ৪৯-৫০
মুঘল পরিবারের লোকজনদের হিন্দুদের হোলি উৎসবে যোগ দেবার রীতিকে ঔরঙ্গজেব বন্ধ করেননি। প্রিয় নাতি আজিম-উল-হাসানকে হোলির বেশ পরিহিতি দেখে তিনি কেবল ঠাট্টা করেছিলেন মাত্র। তাঁর সময়ে মুঘল রাজ দরবারে হিন্দু সভাসদদের ‘রাম রাম’ বলে অন্যান্যদের এমনকি সম্রাটকে সম্বোধন করার ব্যবস্থাও বহাল ছিল।…. দিল্লির রাজসভাতে ১৮২৫ সালে দুর্গাপূজা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।[19]আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩৩০
সম্রাট আওরঙ্গজেবের সুশাসন সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের সমকালের কবি কৃষ্ণরাম দাস লিখেন―
আরং শাহা ক্ষিতিপাল রিংপুর উপরে কাল
.রাজা রাম সর্বজনে বলে।
নবাব শায়িস্তা খাঁ অধিকারী সাত গাঁ
.বহু সরকার করতলে।[20]দিলাওয়ার হোসেন, বাংলা উপন্যাসে মুঘল ইতিহাসের ব্যবহার।[21]মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম, সুখময় মুখোপাধ্যায়, পৃ ২৬১ https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.300702/page/n270/mode/1up
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যদুনাথ সরকারের ‘হিস্ট্রি অব আওরঙ্গজেব’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন –
“তাঁহার আওরঞ্জেবের ইতিহাস অতি সুন্দর গ্রন্থ। লোকে আরঞ্জেবকে যতই মন্দ বলে ততটা মন্দ তিনি ছিলেন না।উনি সেটা বেশ করিয়া দেখাইয়াছেন।উনি আরো দেখাইয়াছেন যে, আরঞ্জেব একজন খুব ভালো রাজা ছিলেন। প্রজা হিন্দু হউক আর মুসলমান প্রজার উন্নতিতে যে রাজার উন্নতি, তাহা তিনি বেশ বুঝিয়াছিলেন এবং সেইমতো কার্য্যও করিতেন। সুতরাং তাঁহার রাজত্বে প্রজা বেশ সুখে ছিল। তাহার সুবেদাররা গর্ব্ব করিতেন যে তাঁহারা টাকায় ৮ মন চাউল বিক্রয় করাইতেন।”[22]হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ‘হিন্দুর মুখে আরঞ্জেবের কথা’, প্রবাসী, জৈষ্ঠ্য ১৩২২,১ম খণ্ড, ২ সংখ্যা, (আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত)
আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের মতে, প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করছে ও নিজস্ব পদ্ধতিতে নিজের ঈশ্বরের উপাসনা করছে।
ড. সতীশচন্দ্রের মতে,
The religious policy of Aurangzeb should be seen in the social, economic and political contexts.[23]D.D Mahajan, Mughal Rule in India, p363
আর যুক্তি কী বলে, উনি ৫০ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন তিনি যদি জোর করতেন তাহলে ভারতে একটাও হিন্দু থাকতো? সবগুলোই তো মুসলমানে পরিণত হয়ে যেতো।
যাইহোক দুটো ইন্টারেস্টিং তথ্য দিয়ে শেষ করি,
আওরঙ্গজেব সম্পর্কে গৌতম ভদ্র ‘মুঘলযুগে অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ’ বইতে দুটো চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরেছেন৷ তিনি দেখিয়েছেন, আহমেদাবাদের বিখ্যাত মসজিদসহ মোট ৩০০টি মসজিদ ভেঙেছিলেন যে ভীম সিংহ তিনিই ছিলেন মারাঠা অভিযানে আওরঙ্গজেবের অন্যতম সহায়। ধর্মীয় বিবেচনার চাইতে রাজনৈতিক প্রয়োজন তাঁর কাছে প্রাথমিক ছিলো বলেই এক মসজিদ ধ্বংসকারীকেও তিনি দামি মনসব ও জায়গীর দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন।[24]গৌতম ভদ্র, মুঘলযুগে অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ, পৃষ্ঠা, ২৮১
আরেকটি ঘটনা হলো, আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে বর্তমান আমেথির জগদীশপুরে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ‘কুর্মি’রা বিদ্রোহ করেছিলো রাজপুত জমিদারদের বিরুদ্ধে। সেখানে ধর্মের ধ্বনিও উঠেছিল। কিন্তু মুঘল রাজশক্তি শেষ পর্যন্ত এই স্বধর্মাবলম্বী কৃষক বিদ্রোহের বিরুদ্ধে যেতে দ্বিধা বোধ করেনি এবং বিদ্রোহ দমনকারী হিন্দুকে তালুকদারি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল।[25]গৌতম ভদ্র, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা, ১৫৭
বিশেষ ঋণঃ ইতিহাস গবেষক আমিনুল ইসলামের গ্রন্থ ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ থেকে বহু উপকৃত হয়েছি এবং সেখান থেকে বহু তথ্য নিয়ে লেখাটা লিখেছি। এ বিষয়ে যারা বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক তারা পড়তে পারেন ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা’: আমিনুল ইসলাম, গবেষক অড্রে ট্রুস্কের Aurangzeb: The Man and The Myth , B.N Pandey-র Islam and Indian Culture, গোলাম আহমেদ মোর্তজার ‘চেপে রাখা ইতিহাস’।
Footnotes
⇧1 | আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩১৪ |
---|---|
⇧2 | অড্রে ট্রুস্কে,আওরঙ্গজেবঃ ম্যান এন্ড দ্য মিথ,পৃ ১৩৮ |
⇧3 | জিজিয়া কি আসলেই শোষণমূলক বিধান? – মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার, Response-To-Anti-Islam https://links.frommuslims.com/weS |
⇧4 | শিবলি নোমানি, আল জিজিয়া। সতীশচন্দ্র, জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র, আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত |
⇧5 | আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ২৯৮. |
⇧6 | আতাহার আলি, দ্য মুঘল নোবলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, পৃ ৩৯. আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত |
⇧7 | আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩০৩. |
⇧8 | অড্রে ট্রুস্কে, পূর্বোক্ত, পৃ ৫১ |
⇧9 | অড্রে ট্রুস্কে, পূর্বোক্ত, পৃ ১০৭ |
⇧10 | থাপার, মুখিয়া ও চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, পৃ ৪১ |
⇧11 | হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, হিন্দুর মুখে আরঞ্জেবের কথা’, প্রবাসী, জৈষ্ঠ্য ১৩২২, ১ম খণ্ড, ২ সংখ্যা, (আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত |
⇧12 | আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩১৫. |
⇧13 | আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা |
⇧14 | অড্রে ট্রুস্কে, আওরঙ্গজেবঃ ম্যান এন্ড দ্য মিথ,পৃ ৫১ |
⇧15 | অড্রে ট্রুস্কে,পূর্বোক্ত, পৃ ৮৭ |
⇧16 | Stanley Lane Poole, Rulers of India, Aurangzeb Part Delhi, p 64, আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত |
⇧17, ⇧19 | আমিনুল ইসলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাস: রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ ৩৩০ |
⇧18 | মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক, পৃ ৪৯-৫০ |
⇧20 | দিলাওয়ার হোসেন, বাংলা উপন্যাসে মুঘল ইতিহাসের ব্যবহার। |
⇧21 | মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম, সুখময় মুখোপাধ্যায়, পৃ ২৬১ https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.300702/page/n270/mode/1up |
⇧22 | হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ‘হিন্দুর মুখে আরঞ্জেবের কথা’, প্রবাসী, জৈষ্ঠ্য ১৩২২,১ম খণ্ড, ২ সংখ্যা, (আমিনুল ইসলাম উদ্ধৃত) |
⇧23 | D.D Mahajan, Mughal Rule in India, p363 |
⇧24 | গৌতম ভদ্র, মুঘলযুগে অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ, পৃষ্ঠা, ২৮১ |
⇧25 | গৌতম ভদ্র, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা, ১৫৭ |